ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী :
বাংলাদেশ সম্ভবত পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ দেশ। কবি হেলাল হাফিজের মতো বাংলাদেশে সম্ভবত এটাও উপলব্ধি করার ক্ষমতা নাই যে, তাদের কেহ নাই, কিছু নাই। সত্তরের দশকে কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন যে, ‘আগুনে পোড়ালে তবু কিছু থাকে,/হোক না তা ধূসর মলিন ছাই,/মানুষে পোড়ালে আর কিছুই থাকে না,/আমার কেহ নাই, কিছু নাই।' যে ইস্যুতে লিখতে যাচ্ছি, সেখানে এই কবিতাটি যে খুব একটা খাপ খায়, তা নয়। এই সরকারকে ভালবেসে ক্ষমতায় এনেছিল যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, ইউএনডিপি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ভারত, সবাই মিলে। এখন তাদের বিদায়ের পালা শুরু হয়েছে। সরকারের দেউটি একে একে নিভে যাচ্ছে। শুধুমাত্র ভারতের পিদিম ছাড়া এই সরকারের আশপাশে আর যে কেহ নাই, কিছু এটি বুঝবার ক্ষমতা এই সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ, এমনকি এমপি, কারো নাই। এরা শেয়ালের মতো প্রধানমন্ত্রীর অবিবেচনাপ্রসূত বক্তব্যের সঙ্গে রা ধরে কেবল সায় দিয়ে যান। এদের কারো কোথায়ও কোনো ব্যক্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় না।
এই সরকারের ভেতরে কোনো স্বাধীন কণ্ঠস্বর নেই। সংসদে একটা বিল পাস হয় উত্থাপন মাত্রই। এর অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করার মতো কোনো যোগ্যতা কারো নেই। অন্তত আমরা দেখিনি। ফলে ষোলকোটি মানুষের দেশ আজ ভয়ানক বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এই সরকারের পা চাটা ভারতনীতির কারণে এদের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের সম্পর্কের ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। কিন্তু এই অবনতিকে সরকার দু'পয়সারও গুরুত্ব দেয় না। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি দেশ থেকে প্রতিদিন সেখানকার কর্মরত বাংলাদেশীদের বিনাকারণেই ফেরত পাঠানো হচ্ছে। বাংলাদেশী পেলেই রাস্তা থেকে ধরে বিমানবন্দরের গরাদ থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে ডাইরেক্ট তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। একেবারেই নিঃস্ব হাতে তারা বাংলাদেশে ফেরত আসছে।
এক্ষেত্রে সরকারি কোনো উদ্যোগই যে কেন কাজ করছে না, সেটি সুদর্শনা, ভ্রমণবিলাসী, অটোগ্রাফ শিকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্বেগের কারণ ঘটাচ্ছে না। তিনি তার ভ্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। যেখানে সচিব বা অতিরিক্ত সচিব গেলেই যথেষ্ট, সেখানে খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিকিৎসায় ডিগ্রীধারী দিপু মনি হাজির হচ্ছেন। অনেক দেশে সাংবাদিকরা বিস্মিত হয়েছেন যে, এই সম্মেলনে সচিব পর্যায়ের কেউ এলেই যথেষ্ট হতো, তারপরেও কেন দিপু মনি? কিন্তু কি তার এই কুড়ি কুড়ি সফরের ফলাফল, সেটা কেউ জানতে পারছে না।
বর্তমান সরকারের গত সাড়ে তিন বছরের শাসনকাল বাংলাদেশের দুঃশাসন আর কলঙ্কের ইতিহাস। ধারণা করি, এই কলঙ্কের কারণে চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন আমাদের ‘বার বার দরকার' প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পৃথিবীর বহু কুখ্যাত শাসকের নাম এখনও মানুষ স্মরণ করে। আধুনিককালে এড্লফ হিটলার, হাইলেসেলাসি, ইদি আমিন, হোসনি মুবারক এরা কুখ্যাত শাসক হিসাবে স্মরণীয়। এসব দেশে বাংলাদেশের ক'জনই বা গেছে? কিন্তু সবাই জানেন, হিটলার অপশাসক ছিলেন। কিংবা অন্যরাও। ফলে তাদেরকেও মানুষ মনে রাখে। এবং আমার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বলতে পারি যে, শেখ হাসিনা সরকারও অপশাসক হিসেবে এদের পাশে ঠাঁই করে নেবেন।
২০০১ সালের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেন শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। সে নির্বাচন অবশ্য সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতির অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শেখ হাসিনার সে কি রাগ! সেই রাগ থেকে ঐ পরাজয়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতেই কিছুদিনের মধ্যেই বলতে শুরু করলেন যে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকার ‘চোর, চোর, মহাচোর'। ভাল। শেখ হাসিনার অাঁচল বিছিয়ে ডেকে আনা মইন-ফকরের অসাংবিধানিক সামরিক সরকার তার টিউনে নাচতে শুরু করে দিলো। এই ইতরেরা শেখ হাসিনার কথা অনুসরণ করে বলতে থাকলো যে, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ বিএনপির সকল লোক, ‘চোর, চোর, মহাচোর'।
লোক দেখানোর জন্য ঐ নষ্ট লোকেরা এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করলো যে, শেখ হাসিনা সরকারও দুর্নীতিবাজ। তারপর বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমানকে গ্রেফতার করে। তার ওপর মইন-মাসুদ যে পৈশাচিক ও লোমহর্ষক নির্যাতন করলো, তাতে তার মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। তিনি লন্ডনে চিকিৎসাধীন। জেনারেল মাসুদউদ্দিনকে শেখ হাসিনা একেবারে কোলে নিয়ে আছেন। এই সাড়ে তিনবছরে কেবলই তার চাকরির মেয়াদ বেড়েই যাচ্ছে। অথচ শেখ হাসিনা যে মাত্রায় প্রতিহিংসাপরায়ণ তাতে ধারণা করা স্বাভাবিক ছিল যে, মইন-মাসুদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। স্বঘোষিত জেনারেল মইনকে সাধারণ মানুষ দেখা হলেই লাথি মারতে পারে এই ভয়ে তিনি নাগরিক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। এবং আশ্চর্য এই যে, মইনউদ্দিন এবং ফখরুদ্দিন দুজনেই কোনো এক সময়ে মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। এরা বাংলাদেশের কেউ নন।
সেটাও শেখ হাসিনা খুব ভালভাবে জানেন। তারপরেও তিনি এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তো নেনইনি, বরং এদের রক্ষার জন্য সর্বাত্মক আয়োজন সম্পন্ন করেছেন। তিনি অনেক হম্বিতম্বি করছেন যে, ভবিষ্যতে আর যাতে কোনো অসাংবিধানিক সরকার আসতে না পারে, সে জন্য তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন। তার অর্থ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। অর্থাৎ জেনারেল মইনের মতো কোনো ইতর যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের একটি তাকে একেবারে অাঁচল বিছিয়ে ডেকে আনে, তখন তিনি সন্তুষ্ট। তারা যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংক, আইডিবি, ইউএনডিপি, আইএমএফ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন প্রভৃতির সমর্থনে ক্ষমতা লাভ করে ফেলেন। মইনউদ্দিন, ফখরুদ্দিন তো অসাংবিধানিক সরকার ছিল, তখন তিনি টু শব্দটিও করেননি। কেন?
এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। কিন্তু আল্লাহতায়ালার বিচার বলে একটি কথা আছে। বিশ্বাসঘাতক, বেঈমান মইনউদ্দিন এখন যুক্তরাষ্ট্রে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। তার মেরুদন্ডের রজ্জু নষ্ট হয়ে গেছে। একটি পত্রিকায় ছবি দেখলাম, গলায় সার্ভিক্যাল স্বার্ফ, পেছনে পট্টিবাঁধা, হুইল চেয়ারে এক লুলা। তিনি জেনারেল মইন। বাংলাদেশের সবচাইতে বড় মীরজাফর, বিশ্বাসঘাতক, ইতর এবং নষ্ট প্রাণী। যখন প্রচ্ছন্নভাবে ক্ষমতায় ছিলেন তখন আফগানিস্তানে তিনমাসের জন্য ক্ষমতায় আহরণকারী দস্যু সর্দার বাচ্চায়ে সকাবের মতো যা খুশি তা করেছে। এই মীরজাফর ভারতে গিয়ে সাত ঘোড়া নিয়ে এসেছে। ট্রয়ের যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ ছিল ঘোড়া। তিনি ভারত সফরে গিয়েছিলেন, যদিও সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন মাত্র, কিন্তু ভারত তাকে রাষ্ট্র/ সরকার প্রধানের মর্যাদায় লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়েছে। এবং বলেছে যে, গত সাঁইত্রিশ বছরে বাংলাদেশে জেনারেল মইনের মতো এমন ভারতীয় মিত্র আর কেউ ক্ষমতাসীন হয়নি।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই যে, জনরোষে এবং সরকার পরিচালনায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যখন তাকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হলো, তখন পূর্বের ষড়যন্ত্রকারীরাই নির্ধারণ করেন যে, মইনের মতো ভারতীয় সেবাদাস কাউকে ক্ষমতায় আসীন করতে হবে। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা আওয়ামী লীগকেই বেছে নিয়েছে। বিএনপির সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য হেন কোনো অপবাদ নেই, যা তারা দেয়নি। বিএনপি দুর্নীতিবাজ, বিএনপি জঙ্গিবাদী, বিএনপি-জামায়াত জোট দেশে ইসলামী মৌলবাদীদের মদদ দিচ্ছে, এমন আরও কত কি। কিন্তু জেনারেল মইনের স্বৈরাচার দুবছর ধরে তদন্ত করেছে। তারা আদালতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে সাক্ষ্য-প্রমাণ যোগাড় করে প্রকাশ করেছিল যে, তিনিই প্রকৃতপক্ষে মহাদুর্নীতিবাজ। কিন্তু ভারত-মার্কিন চাপে মার্কিন চক্র তাকে রক্ষা করতে চায়। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কত অভিযোগ যে আনা হয়েছিল, কত অপপ্রচার যে করা হয়েছিল, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। কিন্তু মইনের সরকার দুইবছর ধরে হাজার তদন্ত করেও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কোনো তথ্যপ্রমাণই হাজির করতে পারেনি। বর্তমান সরকার তার সাড়ে তিনবছর ধরে একই কান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে একটি প্রমাণও হাজির করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা দায়ের করেই যাচ্ছে। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই যে, শেখ হাসিনা তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো মোকাবিলা না করে বরং সে মামলাগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করে নিয়েছে। শুধু তিনিই নন, তার দলের অন্যান্য নেতানেত্রী ও আন্ডাবাচ্চাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হাজার হাজার মামলা তিনি প্রত্যাহার করেছেন।
এখন সরকার একেবারে উলুধ্বনি দিয়ে দুর্নীতিতে নেমে পড়েছে। কিন্তু জোট সরকারের বিরুদ্ধে তাদের চাপা বন্ধ হয়নি। দেশের এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে আওয়ামী নেতাকর্মীরা দুর্নীতি-লুটপাট করছে না। হয়তো তা চাপা দিয়েই রাখা যেত। কিন্তু বাধ সাধল বিশ্বব্যাংক। তারা প্রমাণ পেল যে, শেখ হাসিনার প্রিয়ভাজন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের কোম্পানি ও দুই সচিব সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ায় বিশাল দুর্নীতিতে জড়িত। তারা সরকারকে বলল, এই তিনজনকে না সরালে পদ্মাসেতুতে বিশ্বব্যাংক কোনো ঋণ দিবে না। এবং সঙ্গে সঙ্গে এডিবি, জাইকা, আইডিবি একযোগে সরকারকে জানিয়ে দিল যে, এই দুর্নীতির সুরাহা না হলে তারাও বাংলাদেশকে কোনো ঋণ দেবে না। সরকার তাদের সে কথা মেনে নেয়নি। শুধুমাত্র শেষ পর্যন্ত যা করল, তা হল, আবুল হোসেনকে যোগাযোগ থেকে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে বদলি করে দিল। আর শেখ হাসিনা বড় গলায় বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে বসল যে, বিশ্বব্যাংককে প্রমাণ করতে হবে আবুল হোসেন দুর্নীতি করেছে। বিশ্বব্যাংক তথ্যপ্রমাণও সরকারের কাছে হাজির করল। সরকার সেটা আমলে নেয়নি। শেষ পর্যন্ত পদ্মাসেতুতে ঋণ দেয়ার যে চুক্তি বিশ্বব্যাংক করেছিল, সে চুক্তি তারা বাতিল করে দিল। এবং বিশ্বব্যাংকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক যে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে প্রতিশ্রুতিও তারা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। জাইকা এবং আইডিবিও সম্ভবতও একই পথ অনুসরণ করবে।
আর এই ঘটনা নিয়ে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে ঢিঁঢিঁ পড়ে গেছে। এক আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই যে, দুর্নীতির দায়ে যেদিন বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিল করেছে, সেদিনই শেখ হাসিনা বলেছেন যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই কেবল উন্নয়ন হয়। আর বিএনপি ক্ষমতায় গেলে শুধুই দুর্নীতি হয়। চোরের মার বড় গলা আর কাকে বলে। কিন্তু ক্ষমতার মদমত্ততায় শেখ হাসিনার অন্ধ সরকার কিছুতেই উপলব্ধি করতে পারছে না যে, যারা তাদের আদর করে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, তারা সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আর ভারত তার স্বার্থে যে কোনো সময় অবস্থান বদলে সিদ্ধ হস্ত। মইনের অভিজ্ঞতা থেকে শেখ হাসিনা তা বুঝলে হয়তো ভালই করতো।