শনিবার, ২৬ মে, ২০১২

কোন অতল অন্ধকারের দিকে যাচ্ছি?

কোন অতল অন্ধকারের দিকে যাচ্ছি?



॥ ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ॥

এক অদ্ভুত রাষ্ট্রাচরণের ভেতর দিয়ে এখন আমাদের পথ অতিক্রম চলছে। রাষ্ট্রের পুলিশ-প্রশাসন-বিচার সব কিছু যেন এক পুতুলনাচে পরিণত হয়েছে। কোনো এক বাজিকর সব সুতো নিজ হাতে নিয়ে যখন যেভাবে টানছেন তখন সব কিছুই সেভাবে নাচছে। কোনো কোনো বিচারকের ভাষা ও মন্তব্য কখনো কখনো সাধারণ নাগরিকদের স্তম্ভিত করে দিচ্ছে। কী হচ্ছে দেশটার ভেতরে! কোনো কিছুরই কোনো খেই করা যাচ্ছে না। এ দেশে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র চালু থাকলেও তারা প্রায় এক শAতাব্দী আগে এখানে ধীরে ধীরে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করার চেষ্টা করেছিল এবং সেভাবে এ দেশে ক্রমে ক্রমে একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে 
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি গণতান্ত্রিক চেতনার ভেতর দিয়ে। এমনকি পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত থাকবে নাকি পাকিস্তানের সাথে যোগ দেবে সেটিও ভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছিল। সিলেটবাসী আন্দোলন করে, ভোট দিয়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সব জায়গায়ই জনগণের মতামতকে বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। 
এরপর ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানে তখনো ব্রিটিশ প্রশাসক ছিল। দেশকে পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে তার প্রয়োজনীয়তা ছিল বলেই সে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। ধীরে ধীরে 
পাকিস্তানি জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। আমরাও পাকিস্তানের অংশ ছিলাম। বাংলাদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান। সে আমলে নির্বাচন কমিশন কারচুপির কথা কল্পনাও করতে পারেনি। কেউ কোনো দিন অভিযোগও তোলেনি যে, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। অর্থাৎ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষেরা এসব দায়িত্ব পালন করতেন এবং সরকারই তাদের ওপর এই দায়িত্ব অর্পণ করত। 
এখন মনে হচ্ছে চতুর্দিকে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনো মানুষ নেই। বিবেকসম্পন্ন কোনো লোক নেই। পুলিশ বলি, প্রশাসন বলি, বিচার বিভাগ বলিÑ সর্বত্রই যেন এক সেবাদাস প্রদর্শনী। সরকার যা চায় পুলিশ সেভাবে রিপোর্ট দেয়। ধারণা করার কারণ সৃষ্টি হয়েছে যে, সরকার যা চায় বিচার বিভাগ সেভাবেই রায় দেন। কিংবা ততধিক কঠোর। এর কোথাও বিবেক-বুদ্ধি কাজ করছে বলে মনে হয় না। কোনো কোনো বিচারক কখনো কখনো যে ভাষায় কথা বলেন, তাতে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। যে দলই করেন না কেন, কোনো ব্যক্তি যখন বিচারকের আসনে বসেন, তখন আমরা নিরীহ-সরল বিশ্বাসী মানুষেরা মনে করতে চাই, তিনি বিচারক আসনের মর্যাদা সমুন্নত রাখবেন; কিন্তু এখন সে আশা তিরোহিত হয়ে যাচ্ছে। 
দৃশ্য কিংবা অদৃশ্য এক জাদুকর সব কিছুই সুতোর টানে নিয়ন্ত্রণ করছেন। প্রশাসন বলি, পুলিশ বলি, বিচার বলি, সব কিছুই যেন সেই কারিগর জাদুকরের হাতে বন্দী। এসব অনাচার এমন এক সময়ে কার্যকর ছিল যখন মানুষের শিা ছিল না, বোঝার মতা ছিল না, চোখ-কান উন্মোচিত ছিল না। তারা কেবলই অনুগত ক্রীতদাসের মতো প্রভুর নির্দেশ পালন করে গেছে। এখন দিন বদলেছে, শাসকশ্রেণী সেটা উপলব্ধি করতে পারছে না। স্তাবকেরা শীর্ষস্থানে উঠে আসছে। মহাদুর্নীতিবাজদের মহাশাসক ছোট্ট শিশুর মতো কোলে নিয়ে দোল দিচ্ছেন। এই দোলে সব কিছু দুলছে। জনগণ বলে যে একটা ব্যাপার আছে, সেটা ভাববার প্রয়োজন তাদের পড়ছে না। রাজন্য যা চাইছেন তাই হচ্ছে।
অথচ যুগের যে পরিবর্তন হয়েছে, তিনি তা কোনোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছেন না। বাংলাদেশে সামন্ত যুগের অবসান হয়েছে বহু আগে। সে ইতিহাসজ্ঞান তার নেই। ইতিহাস নিয়ে তার 
চিন্তাভাবনাও নেই। কিছু অশিতি নিম্নশ্রেণীর লোক তার আমত্য। তারা পুতুলের সুতায় নাচছে। রাজা যত বলে পারিষদ দল বলে তার শত গুণ। নাহিদ এক ভদ্রলোক, সিপিবি করতেন। এখন আওয়ামী লীগের শিামন্ত্রী। মন্ত্রণালয়ের পাঁচ-ছয়টা গাড়ি ব্যবহার, ভারতীয় প্রকাশকদের মাধ্যমে টেক্সট বই প্রকাশ করা ছাড়া তার বিরুদ্ধে সুরঞ্জিতের মতো বড় কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু এই নষ্ট ব্যক্তির কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। পাঠ্যবইয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস ৭ই মার্চ পল্টনে শেখ মুজিবের ভাষণ থেকে শুরু। ভেবেছিলাম, তিনি তার মূর্খতার পরিমাপ করতে পেরে কোথাও না কোথাও থামবেন। এই সিপিবি নেতা (নব্য লীগার) তার কোনো পরোয়াও করেননি। ক্ষমতাসীনদের প্রচার-প্রচারণা দেখে মনে হয়, শেখ মুজিবুর রহমান থেকেই এ দেশের নেতৃত্ব শুরু। তার আগে কিছু ছিল না। তারা এখন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উচ্চকিত। আমার অগ্রজ সাংবাদিক প্রেস কাবের সাবেক সভাপতি মোজাম্মেল হক আমাদের সব যুক্তিতর্ক অগ্রাহ্য করে হাস্যোচ্ছলে বলতেন যে, জুলফিকার আলী ভুট্টো যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতেন, তাহলে তো আর মুক্তিযুদ্ধ হতো না। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ গঠন করার প্রয়োজনও পড়ত না। তিনি ঠাট্টা করে বলতেন, তোমরা জুলফিকার আলী ভুট্টোর জন্ম-মৃত্যুদিবস কেন পালন করো না? 
মোজাম্মেল হক এমনই মানুষ ছিলেন। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা অপরিসীম। এর সব কিছুই বলতেন অনর্থক তর্ক বাড়ানোর জন্য। কখনো কখনো আমরা ভাবতাম, সত্যিই তো, যদি জুলফিকার আলী ভুট্টো আপত্তি না করতেন, তাহলে শেখ মুজিবুর রহমানও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতেন। আগেও অনেক পূর্ব পাকিস্তানি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর তার জেনারেলদের সাথে এই বলে শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন যে, ‘ভদ্র মহোদয়গণ, আপনারা পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাাৎ করছেন। তিনি পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।’ সব জেনারেল শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্মানসূচক স্যালুট প্রদান করেছিলেন। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো ও পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র মিলে এ দেশে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করল যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকদের কাছে বন্দী হলেও মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণায় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশের জনগণ বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করল। পাকিস্তানি সরকার শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশে আসার ব্যবস্থা করল, তখনো শেখ মুজিবুর রহমান জানতেন না যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। সে জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতও ছিলেন না। লন্ডনে বিবিসির সাংবাদিক শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠজন সিরাজুর রহমান তার জন্য এক সাংবাদিক সমাবেশের আয়োজন করেন। সেখানে সবাই তাকে ‘ইওর এক্সিলেন্সি’ বলায় তিনি বিস্মিত হয়ে সিরাজুর রহমানের কাছে জানতে চান, এরা তাকে কেন ইওর এক্সিলেন্সি বলছে। সিরাজুর রহমান তখন বলেন, ‘আপনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। সে কারণে এরা আপনাকে ইওর এক্সিলেন্সি সম্বোধন করছে।’ তিনি বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আরে সিরাজ, চালাম স্বায়ত্তশাসন, পালাম স্বাধীনতা।’
সিরাজুর রহমান তার কোনো জবাব দেননি। অর্থাৎ তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডন আসার আগ পর্যন্ত জানতেনই না বা তাকে জানতেই দেয়া হয়নি যে, বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে এবং হাজার হাজার তরুণ-যুবক প্রশিতি পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ লড়াই করে যাচ্ছে।
শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করলেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রমতা হাতে পেয়ে দেশে গণতন্ত্র ধ্বংস করে মতা নিরঙ্কুশ করার জন্য একদলীয় স্বৈরশাসন বাকশাল কায়েম করেছিলেন। এতে বিস্মিত হয়েছিলেন তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীসহ দেশের প্রায় সব শ্রেণীর মানুষ। সে প্রক্রিয়ায় তিনি এমনকি নিজের দল আওয়ামী লীগও নিষিদ্ধ করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় সে আওয়ামী লীগ আবার পুনরুজ্জীবিত হয়।
কিন্তু এখন দেশে তার চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আনুষ্ঠানিকভাবে আইন করে অন্য সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা না হলেও বিরোধী রাজনৈতিক দলকে কোনো কার্যক্রমই পরিচালনা করতে দেয়া হচ্ছে না। সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। মিটিং-মিছিল করতে দেয়া হচ্ছে না। আলোচনায় বসতে দেয়া হচ্ছে না। হাজার হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে সে মামলায় যে কাউকে গ্রেফতারের অধিকার জারি রাখা হচ্ছে। ফলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এখন দারুণভাবে কোণঠাসা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিবসহ ওই দলের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব নেতাকে গাড়ি পোড়ানোর মামলা দিয়ে আটক করে রাখা হয়েছে। তাদের জামিন আবেদন সব আদালতে বারবার নাকচ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেশের মানুষ কিছুতেই বিশ্বাস করছে না যে, গাড়ি পোড়ানোর মতো ঘটনায় এসব ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারেন। সাধারণ মানুষ বরং বলাবলি করছে, সরকারই গাড়ি পুড়িয়ে বিরোধী দলকে ফাঁসিয়ে দেয়ার আয়োজন করেছে। আর সরকারের প্রধান থেকে শুরু করে চাঁইয়েরা পর্যন্ত ঘোষণা করছেন, ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা নির্বিঘেœ মতায় থাকবেন। তার জন্য ইতোমধ্যে সব আয়োজনই প্রায় সম্পন্ন করা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত মাঠে থাকলে অসুবিধা। ফলে এই দুই দলকে হামলা-মামলা দিয়ে দৌড়ের ওপর রাখা হচ্ছে, যাতে তারা রাজনৈতিক কর্মসূচি না নিতে পারে। ভবিষ্যতে কী হবে সে কথা মানুষ বলতে পারে না। ভবিষ্যৎ নির্মাণের পরিকল্পনা করতে পারে মাত্র। বাকি আল্লাহর মর্জি। 
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে বাংলাদেশের ভয়াবহ রিপোর্ট তুলে ধরা হয়েছে। প্রভাবশালী ইকোনমিস্ট পত্রিকা বাংলাদেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রা করতে শেখ হাসিনাকে থামানোর জন্য ভারতকে অনুরোধ করেছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভালো নয়। এর শেষ কোথায় কেউ জানে না। 
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

পথে আনছেন শেখ হাসিনা


ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি তার এক ভাষণে জানিয়েছেন যে, বিরোধীদলকে কিভাবে সঠিক পথে আনতে হয় সেটি তার জানা আছে। কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না পত্রিকায় লিখে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছেন যে, তার সেই পথটি কি, তিনি যেন আমাদের জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে পথের খবর জানাননি। কিন্তু তার ক্রিয়াকর্মে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, সে পথটি কি হতে পারে। দেশবাসী তার নমুনা দেখতে পাচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী গুমের ইস্যুতে বিরোধীদল যখন রাজপথে সোচ্চার তখনই বোঝা গেল প্রধানমন্ত্রীর মনোবাঞ্ছার সেই পথটা কি।
দেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত রাজপথে ধ্বংসাত্মক আন্দোলন করেছিল জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে। তখন শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল বিএনপি। জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তাবিত এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটি তখন একেবারেই নতুন ছিল। দেশের রাজনীতিকজ্ঞ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী মহলে খানিকটা চোখ ঠারাঠারি হয়েছিল- এ আবার কেমন ব্যবস্থা। হুট করে কিছু অনির্বাচিত লোক এসে নির্বাচন করে দিয়ে চলে যাবে, এটা কেমন করে হয়?
কেমন করে যে হয় তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল ১৯৯১ সালে দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য সকল রাজনৈতিক দল মিলে বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদকে ক্ষমতায় আসীন করেছিল দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেওয়া জন্য। বিচারপতি শাহাবুদ্দীন অল্প সময়ের জন্য সে সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সর্বজনগৃহীত নির্বাচন সম্পন্ন করে দিয়ে ফের দেশের প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যান।
ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলেও জাতীয় সংসদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন লাভ করে। তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। আর কোনো কথা না পেয়ে তিনি কিছু না কিছু বলতে হয় হিসেবে বলেছিলেন যে, ফলাফল মেনে নিয়েছেন। তবে নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুবির মাধ্যমে তার দলকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু দেশে বিদেশে কোনো মহলের কাছেই তার এই সূক্ষ্ম কারচুপি তত্ত্ব কোনো ফল দেয়নি। কেউ তার এই তত্ত্ব গ্রহণ করেনি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জামায়াত জোটের যৌথ আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার সংবিধান সংশোধন করে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। তারপর ভালোই চলে আসছিল। ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচন সারা পৃথিবীতে প্রশংসিত হয়েছিল। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। আবার ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বিএনপি সরকার গঠন করে।
সাংবিধানিকভাবে ২০০৬ সালে নির্বাচন প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ সম্ভবত অাঁচ করতে থাকে যে, সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলে নির্বাচনে তাদের জয়লাভের সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। আর সে কারণেই পূর্বের ধারা অনুযায়ী ও সংবিধান মেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ক্ষেত্রে তারা নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা শুরু করে। পূর্ববর্তী যে তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার প্রতিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানই ছিলেন দেশের সর্বশেষ অবসর গ্রহণকারী প্রধান বিচারপতিগণ। কিন্তু ২০০৭ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সংবিধান মোতাবেক সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিতব্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নিতে বা তাদের অধীনে নির্বাচন করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বসলেন। ফলে সারা দেশে এক চরম অরাজকতার সৃষ্টি হয়।
আওয়ামী লীগ কর্তৃক কোনো বিচারপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার না মানায় উপায়ন্তর না দেখে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ সংবিধানের সর্বশেষ অপশন অনুযায়ী নিজেই তত্ত্বাবধায়ক প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য হন। তিনি এই দায়িত্ব নেয়ার পর শেখ হাসিনা শুরুতে তাকে প্রত্যাখ্যান করেননি। বরং বলেছিলেন যে, দেখা যাক উনি কতটা নিরপেক্ষভাবে কাজ করেন।
কিন্তু দিন না যেতেই ভোল পাল্টে গেলো আওয়ামী লীগের। বিএনপির ২০০১ সালের শাসন আমলে সকলক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, বিশ্বখ্যাত অর্থনীতি গবেষক প্রতিষ্ঠান বলতে বাধ্য হলো যে, বাংলাদেশে বর্তমান ধারা চলতে থাকলে আগামী কয়েকবছরের মধ্যেই বাংলাদেশ পৃথিবীর ১২টি নতুন অর্থনৈতিক পরাশক্তির (নিউ ইকোনমিক জায়ান্ট) একটিতে পরিণত হবে। এ খবরে এদেশের অনেক রাজনীতি বিশ্লেষকই ভ্রু কুঁচকেছিলেন। আমি নিজেও শঙ্কাবোধ করে পত্রিকায় নিবন্ধ লিখেছি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বোধ করি ষড়যন্ত্রের কাল শুরু হলো। সরকার ও জনগণকে সর্তক থাকতে হবে যাতে কেউ আমাদের এই উত্থান যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে।
কিন্তু বিএনপি আমলের শেষ দিকে ২০০৬ সাল থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে, ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ভারত ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে শুরু করে খোদ জাতিসংঘ পর্যন্ত এই ষড়যন্ত্রে অংশীদার হয়ে পড়লো। ষড়যন্ত্র অপ্রকাশিতও থাকলো না। ষড়যন্ত্রকারীরা এর জন্য কোনো রাখঢাক করেনি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত, ভারতীয় হাইকমিশনার ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত, ইউএনডিপি প্রতিনিধি, জাতিসংঘের প্রতিনিধি সবাই একযোগে প্রকাশ্যে বাংলাদেশে যাতে সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হতে পারে সে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করলো। তাতে যোগ দিলো আওয়ামী লীগ। ভারতীয় হাইকমিশনার যেন শেখ হাসিনার বাসভবনকে তার দ্বিতীয় কার্যালয়ই করে ফেললেন। তাদের সেকি দৌড়ঝাঁপ! ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন-তারিখ ঠিক হয়ে গেলো। আওয়ামী লীগ তার মনোনয়ন পত্রও চূড়ান্ত করলো। কিন্তু এর মধ্যেই একটি মামলায় আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হলেন সাবেক স্বৈরশাসক ও আওয়ামী লীগের অতি আদরের ধারাবাহিক মিত্র হু. মু. এরশাদ। এই অজুহাতকে সামনে নিয়ে আওয়ামী লীগ ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলো। এবং দেশে এক ধ্বংসাত্মক সন্ত্রাসের রাজনীতির সূচনা করলো।
তারই পরিণতিতে সে নির্বাচন বাতিল হয়ে গেল। সেনাবাহিনী প্রধান লে. জে. মইন উদ্দিন আহমদ অস্ত্রের জোরে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে সম্পূর্ণরূপে সংবিধান লঙ্ঘন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ফখরুদ্দীন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান পদে বসালো। তার আগে ২৮ সেপ্টেম্বর (২০০৬) বিএনপি মেয়াদ শেষ করার দিনই আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠার আন্দোলন করে প্রকাশ্য রাজপথে ডজন খানেক নিরপরাধ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করলো। তারপর শুরু হলো রাজপথ, রেলপথ, নৌপথ অবরোধ। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য রাষ্ট্রপতি সেনা মোতায়েন শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাতে রা রা হায় হায় করে উঠল দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা। আওয়ামী সন্ত্রাসী ও গুন্ডাদের হাতে সারা দেশে শত শত মানুষ খুন হলো। অ্যাম্বুলেন্স চলাচলেও বাধা দেয়ায় বহু মানুষ বিনা চিকিৎসায় অ্যাম্বুলেন্সেই মারা গেল। রেলপথ তুলে দেয়া হলো। সড়ক পথে অবরোধ। নৌ চলাচল বন্ধ।
এখন শেখ হাসিনা কথায় কথায় আদালতের দোহাই দিচ্ছেন। কিন্তু আদালতের রায়ে এরশাদ নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন। সেদিন তো তিনি আদালত মানেননি। এখন তার সাজানো আদালত তার কথা মতোই সবকিছু করে যাচ্ছে বলে মনে হয়। ফলে এখন আদালত বড় প্রিয় হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে আদালত অযাচিতভাবে অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। শেখ হাসিনা সেসব সিদ্ধান্ত ব্যবহার করে কিংবা সেসব সিদ্ধান্তের অপব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছেন। বাতিল করে দিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। যদিও আদালতের রায়ে বলা হয়েছিল পরবর্তী দু'টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। রায়ের শেষ অংশ মেনে নেননি শেখ হাসিনা। তিনি এখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে।
বিএনপি'র সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন গত ১৬ই এপ্রিল। প্রথমদিকে সরকারের তরফ থেকেই বলা হয়েছিল যে, তারা সর্বশক্তি দিয়ে ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের চেষ্টা করবেন। কিন্তু দিন যত যেতে থাকলো, সুর ততই পরিবর্তন হতে থাকলো। একটি পরিবারে স্বামী, পুত্র কিংবা পিতা যদি গুম হয়ে যায়, তাহলে সেই পরিবারে যে শোকের ছায়া নেমে আসে, যে কোনো মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ সেটা উপলব্ধি করতে পারেন। কিন্তু এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রিসভার সদস্য ও নেতারা ইলিয়াস আলীর গুম নিয়ে যেসব কথা বলছেন, তাকে পাশবিক বললেও হয়তো দোষের কিছু হয় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ইলিয়াস আলী গুমের বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবই বিরোধী দল রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করবে। হরতাল আহবান সে কর্মসূচিরই অংশ। এই হরতালকে কেন্দ্র করে সরকার বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে বোমাবাজি ও গাড়ি পোড়ানোর মামলা দায়ের করে। এবং এদের সকলকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। আর কী আশ্চর্য, পুলিশ মাত্র ২২ দিনের মধ্যেই এদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ হাজির করে চার্জশীট দাখিল করেছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনীর নিজগৃহে হত্যাকান্ডের সাড়ে তিন মাসেও যে পুলিশ কিনারা করতে পারেনি, ইলিয়াস আলী গুমের পাঁচ সপ্তাহ পরেও যে পুলিশ সামান্যতম ক্লুও বের করতে পারেনি, তারা একেবারে ২২ দিনে বের করে ফেলেছে যে, মির্জা ফখরুল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সামনে গাড়িতে বোমা মেরেছেন। এবং তিনি ও তার সহযোগীরা আগুন দিয়ে গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছেন।
এর সবই সরকারের বিরোধী দল দমন বা নির্মূলের ফ্যাসিবাদী কৌশল। আওয়ামী চামচা কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী পর্যন্ত সরকারের এ আচরণে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তিনি লিখেছেন, একটি সরকার যখন রাজনৈতিক ও গণভিত্তি হারিয়ে ফেলে তখনই এ ধরনের পেশী শক্তি ব্যবহার শুরু করে। আওয়ামী লীগের জনভিত্তি সমর্থন এখন শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে। এরকম ফ্যাসিবাদীর পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

শুক্রবার, ১৮ মে, ২০১২

সুরঞ্জিতের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র

সুরঞ্জিতের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র



॥ ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ॥

নিজের গঠিত তদন্ত কমিটি সাবেক রেলমন্ত্রী ও বর্তমানে উজিরে খামাখা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে অর্থ কেলেঙ্কারির দায় থেকে রেহাই দিয়েছে। গত ৯ এপ্রিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাড়ির দিকে ৭০ লাখ টাকা মতান্তরে চার কোটি ৭০ লাখ টাকা নিয়ে যাচ্ছিলেন মন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক। গাড়িতে আরো ছিলেন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও নিরাপত্তা প্রধান কমান্ড্যান্ট এনামুল হক। গাড়িচালক আজম খান মন্ত্রীর বাসভবনের অদূরে গাড়িটি জিগাতলার বিজিবি সদর দফতরের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে জানান, এই গাড়িতে বিপুল অঙ্কের অবৈধ টাকা আছে। বিজিবি গাড়িটি আটক করে। পরে এর সত্যতা উদ্ঘাটন করে। তারপর ওই তিনজনকে আটকে রেখে রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ করে।
অবৈধ টাকাসহ কাউকে আটক করার এখতিয়ার সম্ভবত বিজিবির নেই। সে েেত্র সঙ্গত ছিল বিজিবির সংশ্লিষ্ট থানায় খবর দেয়া এবং টাকাসহ ওই তিনজনকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তারা তা করেননি বা করতে পারেননি। তখন পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যে, রাতে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত নিজেই বিজিবির সদর দফতরে যান এবং বিজিবি ও থানা পুলিশের কর্মকর্তাদের সাথে দেনদরবার করেন। পরদিন সকালে টাকাসহ গাড়িটিসহ আটক তিনজনকে বিজিবি ছেড়ে দেয়। এর এক দিন পরে সুরঞ্জিতের এপিএস ওমর ফারুক নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রভাব খাটিয়ে ৭০ লাখ টাকা তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করেন। খবরে জানা যায়, রেলের সাড়ে সাত হাজার নতুন লোক নিয়োগে প্রত্যেকের কাছ থেকে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ নেয়া হয়। সেই টাকা ভাগবাটোয়ারায় সুরঞ্জিতের অংশ তার ঝিগাতলার বাসায় পৌঁছে দিতে ওই তিন কর্মকর্তা রওনা হয়েছিলেন। 
এ ঘটনা মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়ে পড়লে পরদিন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নানা আবোল-তাবোল বলতে শুরু করেন। তিনি বলেন, এপিএসের আমার বাসায় আসার কোনো কারণই নেই। তিনি নাকি ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে যান। অথচ এনামুল ও মৃধা বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তার এপিএসকে আটক হওয়ার আগ পর্যন্ত ঘন ঘন ফোন করেন। আর এপিএস তার অবস্থান জানাচ্ছিলেন। এপিএসের গাড়িতে ৭০ লাখ টাকা সম্পর্কে সুরঞ্জিত বলেন, কারো তো এমন টাকা থাকতেই পারে। তাতে দোষের কী? এপিএস ওমর ফারুক প্রথমে বলেছিলেন, কী এক অনুষ্ঠান উপলে তার শ্যালক তাকে ২০ লাখ টাকা পাঠিয়েছে। তার পরেও প্রশ্ন থাকে, বাকি ৫০ লাখ টাকার উৎস কোথায়? আবার পত্রিকাগুলো অনুসন্ধান করেও ওই শ্যালক সম্পর্কে আর কিছু জানতে পারেনি। তারপর নিজ গাড়িতে ৭০ লাখ টাকা নিয়ে কোন পাগল ঘোরাফেরা করবে! সে েেত্র এটা খুব সঙ্গত ছিল যে, এপিএস সাহেব পুলিশের পাহারা চাইবেন। কিন্তু তা না চেয়ে পাহারাদার হিসেবে রেলের জিএম ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে সাথে নিলেন কেন? এপিএস যে গাড়িতে যাচ্ছিলেন, সে গাড়িতে জাতীয় সংসদের স্টিকার লাগানো ছিল। রেলঘটিত নিয়োগবাণিজ্যের কোনো ব্যাপার যদি না-ই থাকবে, তাহলে রেলের জিএম মৃধা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা কেন তার সঙ্গী হলেন?
পরদিন মিডিয়ার ওপর একহাত নিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি বললেন, ব্যাপারটা অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। তা না হলে ঘটনা ঘটার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মিডিয়া কেমন করে ক্যামেরা-মাইক্রোফোন নিয়ে হাজির হলো। এর ভেতরে ষড়যন্ত্র আছে। ভাবখানা এমন যে, না হয় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস, রেলের পূর্বাঞ্চল মহাব্যবস্থাপক ও প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা বিপুল অঙ্কের টাকাসহ বিজিবি গেটে আটক হয়েছেনই, তাই বলে মিডিয়া তা প্রচার করে দিবে? তিনি এ-ও বলেছেন, মিডিয়া ভারি নিষ্ঠুর। অথচ হুঁশে থাকলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এই প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জন্য মিডিয়ার প্রশংসা করা উচিত ছিল। শ্রী সেনগুপ্তের ধারণা নেই যে, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট উভয় মিডিয়াই ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে কাজ করে। সম্ভবত তার এ ধারণাও নেই যে, প্রত্যেক মিডিয়ায় ইমার্জেন্সি সেল আছে। এ রকম যেকোনো ঘটনা হলে সেখানে ছুটে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। উপরন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তারা পরস্পরকে সহযোগিতা করে থাকেন। কখনো কখনো ঘটনার গুরুত্ব বুঝলে এক মিডিয়া অন্য মিডিয়াকে সহযোগিতা করে। ঘটনাটি জানায়। তখন তারাও ছুটে আসে। এখন পথচারীরাও এ রকম কোনো দৃশ্য দেখলে মিডিয়ায় ফোন করে জানায়। এসব বাজে ব্যাপার সুরঞ্জিত বাবুর মনঃপূত হয়নি। তার এই বিরক্তিতেও প্রমাণিত হয়েছে, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। কিছু একটা ব্যাপার এতে আছে। তিনি তো সাফাই গেয়েছিলেন, ওই টাকা তার এপিএসেরই। এর দায়দায়িত্ব তার নয়। তাহলে মিডিয়ার ওপর তিনি এত বিরক্ত হয়ে উঠলেন কেন? 
এ ঘটনার পর সারা দেশে ছিছি-ঢিঢি রব পড়ে যায়। অন্য মন্ত্রীরাও লজ্জায় অধোবদন হয়েছিলেন। তখন প্রধানমন্ত্রী বিদেশে ছিলেন। সফর শেষে ঢাকায় ফিরে এ ঘটনায় নিশ্চয় তিনি ুব্ধ হয়েছিলেন। বিএনপির লোকেদের এত দিন ধরে বিনা প্রমাণে ‘চোর চোর মহাচোর’ বলে গালি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সেখানে সুরঞ্জিত বাবুর এপিএস বিরাট অঙ্কের টাকাসহ গ্রেফতার হওয়ায় তিনি বিব্রত হয়েও থাকতে পারেন। ফলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যখন প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে পদত্যাগের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন, প্রধানমন্ত্রী তাতে সদয় সম্মতি দেন। এরপর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৬ এপ্রিল পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে গাড়ি থেকে মন্ত্রীর পতাকা খুলে বাসায় চলে যান। কিন্তু রহস্যময় ব্যাপার হলো এইÑ তার মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কেন আবার দফতরবিহীন মন্ত্রী বানালেন? 
এ রহস্য খুব জটিল নয়। এ দেশের ঘটনা পরম্পরা ল করলেই এর একটা কিনারা পাওয়া যাবে। এবারের আগেরবার যখন ভারতের বর্তমান অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন, তখন প্রধানমন্ত্রীর সাথে তিনি আধাঘণ্টা কথা বলে বিদায় নিয়েছিলেন। কিন্তু সুরঞ্জিত-রাজ্জাক-তোফায়েল-আমুর সাথে তিনি একান্তে দেড় ঘণ্টা কথা বলে গিয়েছিলেন। সে বৈঠকও সম্ভবত শেখ হাসিনার জন্য একটি বার্তা বহন করছিল। তবে কি মুখে যতই চুনকালি পড়–ক, সরকার এ রকম একটি অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে স্বাধীন নয়? 
এই টাকার বস্তার ঘটনা তদন্তে মন্ত্রী তার অধীনস্থ দুই কর্মকর্তাকে দিয়ে দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তখনই বোঝা গিয়েছিল, এ তদন্তের ফলাফল লবগণ্ড হবে। তার একটি কমিটির প্রধান ছিলেন রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহের ও সাথে ছিলেন যুগ্ম সচিব শশীকুমার সিংহ। এই কমিটি এপিএসের গাড়িতে পাওয়া ওই টাকার বস্তার সাথে মন্ত্রীর কোনো সংশ্লিষ্টতা পায়নি। ফলে তিনি কুল্লেখালাস। সাফ্ফান সাফ্ফা। তিনি এবার নিজেই গর্ব করে বলতে পারেন, সুরঞ্জিতের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। 
এই তদন্ত ও তদন্ত রিপোর্ট সম্পর্কে বিশিষ্টজনেরা বলেন, এই তদন্ত কমিটি অর্থহীন ও মতাহীন। মন্ত্রীর অধীনস্থ কর্মকর্তারা মন্ত্রীর দুর্নীতি তদন্তের এখতিয়ারই রাখেন না। তদন্ত কমিটির টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন্সে মন্ত্রী দুর্নীতি করেছেন কি না কিংবা মন্ত্রীর বিষয়ে কোনো কিছুর তদন্ত করার এখতিয়ার ছিল না। তাহলে তদন্ত কমিটি কোন বিবেচনায় বলে বসল যে, ওই টাকার সাথে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কোনো সম্পর্ক নেই। যা হওয়ার কথা ছিল, তাই হয়েছে। তদন্ত যা-ই হোক, মন্ত্রীর চরিত্র ফুলের মতো পবিত্রÑ এটা বলা ছাড়া কমিটির আর কী-ই বা গত্যন্তর ছিল। এরও বা কিছুটা সুরাহা হতে পারত। কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আবার যখন দফতরহীনভাবে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেলেন, তখন নিশ্চয় তদন্ত কর্মকর্তারা সতর্ক হয়ে যান। আজ দফতরবিহীন আছেন, কাল যে আবার রেলওয়েরই মন্ত্রী হবেন না, এমন তো কোনো কথা নেই। আর ঘটনাও তাই। ওই অর্থহীন তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দেয়ার পর মন্ত্রী আবার গণমাধ্যমের সামনে এসে হাজির হন এবং পুনরায় রেলমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। 
এর সব কিছু একেবারেই লোকদেখানো এবং গোঁজামিল মাত্র। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত। তিনি যেহেতু মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, যেহেতু সাংবিধানিকভাবে মন্ত্রিসভা সংসদের কাছে দায়বদ্ধ, তাই বর্তমান পদে তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদের অধীনে সংসদের প থেকে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, তিনি একজন সংসদ সদস্য। তার আচরণের কারণে সংসদ অবমাননা বা সংসদের সুনাম ও মর্যাদা ুণœ হয়েছে কি না তা তদন্তে আরেকটি কমিটি গঠন করা দরকার। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বলেন, রেলওয়ের তদন্ত কমিটি ও প্রতিবেদন নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমত, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মন্ত্রী থাকাবস্থায় তার অধীন রেলওয়ের মহাপরিচালক মো: আবু তাহের ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব শশীকুমার সিংহকে দিয়ে এ তদন্ত কমিটি গঠন করেন। মন্ত্রীর অধীনে চাকরি করা কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছেন কিনা? দ্বিতীয়ত, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগের পর অসাংবিধানিকভাবে তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করা হয়েছে। এ অবস্থায় সরকারি কর্মকর্তারা কতটুকু নিরপেভাবে তদন্ত করতে পেরেছেন। তৃতীয়ত, ঘটনার রাতে তার এপিএস ওমর ফারুক, রেলওয়ের কর্মকর্তা ইউসুফ আলী মৃধা ও নিরাপত্তাকর্মী কমান্ড্যান্ট এনামুল হক অনেক টাকাসহ মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলেন। কেন তারা যাচ্ছিলেন সে বিষয়টি পরিষ্কার নয়। চতুর্থত, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও ঘটনার সাথে জড়িতদের মোবাইল কললিস্ট পরীা করা হয়েছে কি না। এপিএস ও রেল কর্মকর্তারা বাসায় যাওয়ার আগে সুরঞ্জিতের সাথে কতবার কথা বলেন, বিজিবি থেকে তাদের ছাড়িয়ে আনতে মন্ত্রী কতবার কতজনের সাথে যোগাযোগ করেনÑ তা তদন্ত করা হয়েছিল কি না। পঞ্চমত, বিজিবি তাদের কেন ছেড়ে দিলো এবং সর্বশেষ কথা হলোÑ গাড়িচালকের বক্তব্য ছাড়াই রিপোর্টটি তৈরি করা হয়। এত সব কারণে তদন্ত কমিটি ও প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
এসব প্রশ্ন সঙ্গত। এগুলোর কিনারা হলো না। তারপরও যদি জানা যেত, সামান্য এক এপিএস এত টাকা কোথায় পেল, তাহলেও তদন্তটি কোনো একটা অর্থবহন করতে পারত। সেটিও হলো না। দেশের সাধারণ মানুষ জানতে চায় এপিএসের এত নগদ টাকার উৎস কী? এই টাকাসহ তার গাড়িতে কেন মৃধা বা এনামুল উপস্থিত ছিলেন। তার ওপর যে সাধারণ মানুষ গাড়িচালক তার কোনো ভাষ্যও পাওয়া গেল না। ঘটনার পরদিন থেকেই গাড়িচালক আজম খান গায়েব হয়ে গেলেন। তার পরিবার জীবনের নিরাপত্তাহীনতায়; আজ এখানে তো কাল সেখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রধান ও সম্ভবত নিরপে সাী বলে তাকে কি গুম করে ফেলা হয়েছে? তাকে আর খুঁজে না পাওয়াও সুরঞ্জিতের টাকার বস্তার রহস্য উন্মোচনে প্রধান অন্তরায়। এর পরও গত ১৬ মে এক মাস হাইবারনেশনে (সাপ বা ঠাণ্ডা রক্তের প্রাণীর শীতনিদ্রা) থাকার পর মিডিয়ার সামনে ফিরে সুবোধ সুরঞ্জিত দাবি করলেন, রেলের ইতিহাসে এত বড় নিরপে তদন্ত কমিটি আর কোনো দিন গঠিত হয়নি। সেই কমিটির রায়ে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। অতএব, প্রধানমন্ত্রী চাইলে তাকে আবার রেল মন্ত্রণালয় দিতে পারেন। আর তিনি নতুন উদ্যোমে চালিয়ে যেতে পারেন পুরনো কাজ। সাবাস সুরঞ্জিত! 
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

বুধবার, ১৬ মে, ২০১২

এ কেমন স্বদেশ! এ কেমন শাসন!


ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
ক্রমেই অচেনা মনে হচ্ছে আমাদের এই মাতৃভূমিকে। সরকার এদেশের ষোল কোটি মানুষকে যেন নিজ দেশেই পরবাসী করে ফেলছে। প্রশাসন, পুলিশ এমনকি বিচার বিভাগকে পর্যন্ত অচেনা মনে হতে শুরু করেছে। সরকার দাবি করে আসছে যে, জনগণের ভোটেই নাকি তারা নির্বাচিত হয়েছে। কিন্তু জনগণের আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-সাধ সব কিছুকে পদদলিত করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। এখানে লুটেরা, ঘাতক, দুর্নীতিবাজেরা শাস্তি তো দূরের কথা পুরস্কৃত হচ্ছে। তিরস্কৃত হচ্ছে ন্যায়-নীতি। আইন বিচারের কামনাকারী নাগরিকরা। খুনি, লুটেরারা সরকারের মদদ, প্রশ্রয় পাচ্ছে। সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে ন্যায়বিচারের আশা তিরোহিত হয়ে গেছে। নাগরিকরা এখন যেন বন্দী জীবন-যাপন করছে। মানুষ দেদারছে খুন হচ্ছে। সরকার তার প্রতিরোধ-প্রতিকার করতে পারছে না। কিংবা প্রতিকার করছে না। মানুষ গুম হচ্ছে, তাকে উদ্ধার অভিযান নিয়ে সরকার কেবলই ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। এখন যে যেখানে খুশি, যাকে খুশি খুন করে, গুম করে ফেলছে। সরকারী বাহিনী এর ব্যতিক্রম নয়।
ফলে গুম এবং খুনের আতঙ্কে গোটা দেশের মানুষ এখন ভীত-সন্ত্রস্ত। পথ চলতে ভয়। এই বুঝি কোথা থেকে কী এক দল সাদা পোশাকধারী নিজেদের আইনশৃক্মখলা বাহিনীর লোক পরিচয় দিয়ে যে কাউকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। নিরাপত্তার জন্য মানুষ ঘরে ফিরে আসে। প্রধানমন্ত্রী সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সরকার কারো বেডরুম পাহারা দিতে পারবে না। নিরাপত্তার জন্য মানুষ গাড়িতে করে ফেরার চেষ্টা করছে। গাড়ি থামিয়ে সাদা পোশাকধারীরা তাদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ এখন মনে করছেন, রাস্তাঘাটে চলাচলের জন্য বাসই নিরাপদ। সেখানে অনেক মানুষের ভেতর থেকে নিশ্চয়ই কেউ তাকে তুলে নিয়ে যেতে পারবে না। গুম করতে পারবে না। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুনের কিনারা তিন মাসেও হয়নি। তদন্তকারী পুলিশ বাহিনী জানিয়েছে, তারা কোনো কিনারা করতে পারেনি। আদালত র‌্যাবকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। প্রায় দুইমাস পর ঐ দম্পতির গলিত লাশ কবর থেকে তুলে এনে ভিসেরা পরীক্ষার নাটক করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ ধরেই নিয়েছে যে, এসবই লোক-দেখানো নাটক। সাগর-রুনি হত্যার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন যে, আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা হবে। গ্রেফতার করা হলো না।
শেষ পর্যন্ত এই হত্যার রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে নিয়েছিলেন। তখনই বোঝা গিয়েছিল যে, সাগর-রুনির কবরের মতো এ হত্যাকান্ডের কিনারা কবরে ঢুকলো। বিএনপি'র সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী গুম হয়ে গেলেন রাত বারোটায় বাড়ি ফেরার পথে। অনেকেই প্রত্যক্ষ করলো যে, আইনশৃক্মখলা বাহিনীর সদস্যরাই তাকে ও তার গাড়ির চালককে জোর করে তুলে নিয়ে গেছে। তারপর ইলিয়াস আলীর আর কোনো খোঁজ নেই। প্রধানমন্ত্রী নিজমুখে ইলিয়াস আলী সম্পর্কে এমন সব কথা বললেন, যাতে গা শিউরে ওঠে। প্রথমে তিনি বললেন, বিরোধীদলীয় নেত্রীর নির্দেশেই ইলিয়াস আলী আত্মগোপন করে আছেন। তারপর বললেন, ইলিয়াস আলীকে তার দলের লোকরাই গুম করেছে। তারপর বললেন, ইলিয়াস আলী এর আগেও আত্মগোপন করেছিলেন। পরে হঠাৎ বেরিয়ে আসেন। শেষমেশ বলেছেন, ইলিয়াস আলী নিজেও এক ভয়ানক সন্ত্রাসী ছিলেন।
একইভাবে তুলে নেয়া হলো বাসের ভেতর থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রকে। বাসভর্তি লোক দেখলেন, র‌্যাবের লোকেরা তাদের বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আজ পর্যন্তও ঐ দুই ছাত্রের কোনো সন্ধান মেলেনি। সবচাইতে আশ্চর্য কান্ড ঘটেছে সরকারের মনোভাবের মধ্য দিয়ে। এই দুই ছাত্র সম্পর্কে এক রিট পিটিশনের সিদ্ধান্তকালে ১৬ মে'র মধ্যে পুলিশ প্রধানকে সশরীরে আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, কেন তার বাহিনী কোনো গুম-অপহরণের ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত করতে পারছে না।
কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই যে, আইজিপিকে এই হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য স্বয়ং অ্যাটর্নি জেনারেল পরদিন ছুটে গেলেন চেম্বার জর্জ আদালতে। গিয়ে তিনি এই হাজিরার আদেশের বিরুদ্ধে আর্জি জানালেন। আর সঙ্গে সঙ্গে চেম্বার জজ ঐ হাজিরা চার সপ্তাহ পিছিয়ে দেয়ার রায় দিলেন। দেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা আদালতের কাছে পুলিশের জবাবদিহিতার বিরুদ্ধে কেন দাঁড়ালেন? অ্যাটর্নি জেনারেল নিজে পুলিশও নন, তদন্তকারীও নন। তাহলে আইজিপিকে ব্যাখ্যা দেবার বাধ্যবাধকতা থেকে রক্ষা কেন করতে হবে? চেম্বার জজ অ্যাটর্নি জেনারেলকে এমনও জানিয়েছেন যে, আইজিপিকে হাজিরা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার আবেদন নিয়ে তিনি যেন সুপ্রীম কোর্টের রেগুলার বেঞ্চে হাজির হন। গা শিউরে ওঠার মতো খবর বৈকি।
এর ফলে দুটো জিনিস প্রায় প্রমাণিতই হয়ে গেল। এসব গুম-অপহরণ ঘটেছে ঘটুক, তার জন্য আইজিপিকে আদালতের সামনে হাজির হওয়ার দরকার নেই। আর অ্যাটর্নি জেনারেলের এই উদ্যোগের ফলে এ অভিযোগও প্রায় প্রমাণিত হয়ে গেল যে, এসব গুম-অপহরণের সঙ্গে সরকারের একটি মহলের যোগসাজশ রয়েছে। তা না হলে এক্ষেত্রে বিচার ও জবাবদিহিতাকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া হতো। এখানে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়তো না। তবে কি এই ভয় ছিল যে, হাইকোর্টের জেরার কোনো ফাঁক দিয়ে পুলিশ প্রধান বলতে বাধ্য হন কিনা যে, সরকারের অমুক মহলের নির্দেশে তদন্তে অগ্রগতি করা সম্ভব হচ্ছে না। অমুক মহলের নির্দেশে তদন্ত কাজ মাঝপথে থামিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ দুই ছাত্রকে যখন আইনশৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনী বাস থামিয়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন বাসের হেলপার তাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন ওদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। এর জবাবে তারা বলেছিল, ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শেষেই এদের ছেড়ে দেয়া হবে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার জানিয়েছে, তাদের অপহরণের সঙ্গে ডিবি পুলিশ এবং র‌্যাব-৪-এর সদস্যরা জড়িত। তারা আসছিল কুষ্টিয়া থেকে বাসে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১টায় নবীনগর থেকে তাদের র‌্যাব পুলিশ নামিয়ে নেয়। যে মাইক্রোবাসে করে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তাতে ৭/৮ জন ছিল। তাদের কারো কারো গায়ে ছিল গোয়েন্দা সংস্থার জ্যাকেট এবং অন্যদের পরনে ছিল র‌্যাবের পোশাক। 
কিন্তু এই দু'মাসেও তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। তাদের পরিবারের সদস্যরা আইনশৃক্মখলা বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করেছে। তাতেও কোনো সুরাহা হয়নি। তারা এখনও নিখোঁজ। অধিকার জানিয়েছে, ডিবি কর্মকর্তা ওয়াহেদুর জামান অধিকারকে বলেছে, ঐদিন নবীনগর এলাকায় ঐ বাহিনী কোনো তল্লাশী চালায়নি। এদিকে র‌্যাব কর্মকর্তা লে. কর্নেল আবদুল্লাহ ইবনে জায়িদ এ সম্পর্কে অধিকারের কাছে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন।
ঐ ছাত্রের একজনের বাড়ি পিরোজপুর। অপরজনের বাড়ি ঝালকাঠি। একজন ঢাকায় এসেছিল একটি মিউজিক অ্যালবাম তৈরি করার জন্য। অপরজন এসেছিল কিছু জিনিস ছাপিয়ে নেয়ার জন্য। হাইকোর্ট একটি রিট আবেদনের জবাবে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র সচিব, র‌্যাব ডিজিসহ মোট নয়জনের ওপর তিন সপ্তাহের মধ্যে অপহৃত ঐ দুই ছাত্রকে আদালতের সামনে হাজির করতে বলে। তিন সপ্তাহ পর আদালতে হাজির হয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান যে, নিখোঁজ দুই ছাত্রের কোনো খোঁজ তারা জানেননি। এতে আদালত সন্তুষ্ট হতে পারেননি। আদালত নির্দেশ দেন যে, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এই অপহরণের তদন্তের বিষয়টি তারা যেন আদালতকে জানান। এক সপ্তাহ পর তারা আদালতে হাজির হন এবং কোনো তথ্য দিতে ব্যর্থ হন। এই প্রেক্ষিতেই ১৬ মার্চ সশরীরে হাজির হয়ে আইজিপিকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দেন আদালত। এবং ব্যাখ্যা করতে বলেন যে, বাদীর দাবি অনুযায়ী তারা র‌্যাব ক্যাম্পে আটক আছে, সেখান থেকে তাদের কেন উদ্ধার করা হয়নি। এমনকি তদন্ত কর্মকর্তা তাদের মোবাইল কললিস্ট পরীক্ষা করে জানাতেও পারেননি যে, অপহরণের আগে কার কার সঙ্গে তাদের কথা হয়েছিল।
এদিকে গত সপ্তাহে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে অভিযোগ করেছেন যে, তার স্বামীকে উদ্ধার করার জন্য আইনশৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর থেকে এ পর্যন্ত পুলিশ তাকে আর কিছু জানায়ওনি। এতে তিনি খুবই অসহায় বোধ করছেন। এদিকে বিএনপি প্রথম থেকেই অভিযোগ করছিল যে, ইলিয়াস আলীকে সরকারই গুম করেছে এবং তাকে ফেরত দেয়া হোক।
এদিকে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ দুই ছাত্র এবং বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর অপহরণের ঘটনার মধ্যে সাযুজ্য রয়েছে। অপহরণকারীরা একই ধরনের মাইক্রোবাসে করে অপহরণ করেছে। এবং অপহরণকারীদের পরনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পোশাক ছিল। আরও যারা অপহৃত হয়েছেন তাদের আত্মীয়স্বজনও বরাবরই অভিযোগ করে আসছেন, অপহরণকারীদের পরনে আইনশৃক্মখলা বাহিনীর পোশাক ছিল। কিন্তু ডিবি বা র‌্যাব বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। শেষ পর্যন্ত আদালতের কাছে প্রকৃত ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে আইজিপিকে আদালতে হাজির হওয়ার বিরুদ্ধে অ্যাটর্নি জেনারেলকে দাঁড়াতে হয়েছে। এ কেমন অচেনা স্বদেশ! এ কেমন অচেনা শাসন!

মঙ্গলবার, ৮ মে, ২০১২

খুঁচিয়ে ঘা করছে সরকার



ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী :
 সমাজে হাজারো অঘটন প্রতিনিয়ত ঘটছে। গুম এখন সরকারি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। শোনা যায়, অর্থের বিনিময়ে যে কাউকে যে কোনো সময় আইনসিদ্ধভাবেই গুম করে ফেলা যায়। দ্রব্যমূল্য প্রতিনিয়ত বাড়ছে। গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কট বাড়ছে। ডিজেল-পেট্রোলের দাম বেড়েছে। আরও বাড়বে। গোটা সমাজ, প্রশাসন দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ ও তার ছানাপোনাদের সন্ত্রাসে অনিরাপদ হয়ে উঠেছে গোটা জনপদ। বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে হেন কোনো পদ্ধতি নেই যা সরকার ব্যবহার করছে না। হামলা-গ্রেফতারেও কাজ হচ্ছে না। কোথা থেকে পঙ্গপালের মতো মানুষ ছুটে এসে বিরোধী দলের কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছে। এখন চলছে মামলা। আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সরকার তার অপকর্ম ধারাবাহিকভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে। আদালতের এমন নির্লজ্জ দলীয়করণ এদেশে আর কেউ কোনোদিন দেখেনি। দলীয়ভাবে হয়তো নিয়োগ হয়েছে, কিন্তু তারা যখন শপথ নিয়ে বিচারকের আসনে বসেছেন, তখন বিচারকের মর্যাদার কথাটা তারা স্মরণে রেখেছেন। এখন সে মূল্যবোধ উধাও হয়ে গেছে। কোনো কোনো বিচারক কখনও কখনও এমন ভাষায় কথা বলছেন বলে অভিযোগ রয়েছে যাতে চমকে ওঠার অবস্থা। চোর-খুনি-ডাকাত-বাটপার-লুটেরা-ঘুষখোর সবকিছু সরকারের মদতে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলে ফেঁপে সমাজকে গিলে খাওয়ার চেষ্টা করছে। মূল্যবোধকে আইনের মাধ্যমেই অবক্ষয়িত করা হচ্ছে।
যে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যের কারণে এই বঙ্গভূমি পূর্ব পাকিস্তান হয়েছিল, তারপর হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ, সেই স্বাতন্ত্র্যের বিলোপ সাধনের জন্য প্রতিনিয়ত সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যই যদি না থাকতো, তাহলে পূর্ব বাংলার মানুষও আসামের অন্তর্ভুক্ত বৃহত্তর সিলেটের জনসাধারণ পাকিস্তানের পক্ষে যাবার জন্য ভোট দিত না। স্বাধীন বাংলাদেশও প্রতিষ্ঠিত হতো না। এই জনপদও যদি হিন্দু অধ্যুষিত হতো তাহলে বাংলাদেশের পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার প্রশ্নই উঠতো না। ভারতের সঙ্গে একাকারই থাকতো। এখন সবকিছু ভুলিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করছে সরকার। অর্থাৎ এই সরকারের অধীনে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব এখন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে দেশে চলছে প্রহসন। তথাকথিত সাক্ষীর পুলিশী জবানবন্দীকেই সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করার বিধান চালু করা হয়েছে। আদালতে তাদের হাজির করার প্রতিষ্ঠিত ও শতাব্দী প্রাচীন আইন ও নিয়মাবলী লঙ্ঘন করা হচ্ছে এবং ন্যায়বিচারের রেওয়াজ বিলুপ্ত করা হয়েছে। আসামী পক্ষ তাদের জেরা করার কোনো সুযোগ পাচ্ছে না। তারা সত্য না মিথ্যা বলছে, তাদের বক্তব্য মতলবী কিনা, অর্থবিত্তের প্রলোভন কিংবা জুলুম নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে কথা আদায় হয়েছে কিনা যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে তা প্রমাণের এখন আর কোনো প্রয়োজন নেই। কিংবা সত্যি সত্যি এরকম কোনো সাক্ষী আছে কি না, নাকি সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নির্মূলের প্রয়াসে এমন বানোয়াট জবানবন্দী তৈরি করেছে, তাও আর প্রমাণ করা যাবে না। এমন সব সাক্ষীর জবানবন্দী আনা হয়েছে যারা চল্লিশ বছর আগে ভিন্ন দেশের অভিবাসী হয়ে চলে গেছেন। এরা অনেকটা উপন্যাসের চরিত্রের মতো। এখন মনে হচ্ছে যুদ্ধাপরাধের বিচার উপন্যাসের ভিত্তিতে সম্পন্ন করার চেষ্টা করছে সরকার। বিরোধী দল নির্মূলে এ একটা পদ্ধতি বটে। একেক দলের ক্ষেত্রে একেক ব্যবস্থা। রাজাকার মানেই যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধ হতে পারে না।
এ বিচারের যখন আয়োজন করা হয়, তখন সারা পৃথিবী সোচ্চার হয়ে ওঠে। এর নাম দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩। যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইবুনাল। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠনের এবং তার নিয়মনীতির কোনো কিছুই সরকার মান্য করেনি। সারা পৃথিবী প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে সরকার জানিয়ে দেয় যে, এটা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল নয়। এটা ডোমেস্টিক বা অভ্যন্তরীণ ট্রাইব্যুনাল। যেন এতেই পৃথিবীর মুখ বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ হয়নি। এখনও বিশ্বব্যাপী এই প্রহসনকে মানবতাবিরোধী বলে অভিহিত করা হচ্ছে। কিন্তু সরকার বেপরোয়া।
ভারত আছে পাশে। অতএব পৃথিবীর আর কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্কের দরকার নেই সরকারের। ফলে নিকট প্রতিবেশী চীন দূরবর্তী হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে সরকারের প্রতি ঘৃণা সঞ্চার হয়েছে। সেখানেও নতুন জনশক্তি নিয়োগ তো বন্ধ হয়েছেই, পুরনো যারা আছে তাদেরকেও দলে দলে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। সৌদী কূটনীতিক খুনের ঘটনার কোনো কিনারাই করতে পারেনি সরকার। তাদের তদন্ত দল এসেছিল। বাংলাদেশের অর্থহীন তদন্ত কার্যক্রমে তারা বিস্ময় আর হতাশা নিয়ে ফিরে গেছেন। ফলে যেটা হয়েছে, গোটা মধ্যপ্রাচ্য এখন বাংলাদেশের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কুয়েতের পরিস্থিতি কিছুটা সহনশীল ছিল। এখন সে কুয়েতও বাংলাদেশীদের দল বে্ধে ফেরত পাঠাচ্ছে। ১৫/২০ বছর যারা সেখানে ব্যবসায়-বাণিজ্য করেছেন, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তারা দেশে এলে আর ফেরত যেতে পারছেন না। অনেককে কুয়েতের বিমানবন্দর থেকে ফিরতি ফ্লাইটে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ফলে রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে পড়ছে সম্পন্ন মানুষ।
এদিকে সরকারের কোনো মনোযোগ আছে বলে মনে হয় না। এদের পূর্বসূরি এদেরই ডেকে আনা মীরজাফর মইনের সরকারের সময় থেকেই এই ধস শুরু হয়েছিল। তখন তাদের এক অর্বাচীন উপদেষ্টা ইফতেখার চৌধুরী গলা ফুলিয়ে বলেছিলেন যে, মধ্যপ্রাচ্য যদি জনশক্তি না নেয়, না নেবে। আমরা সারা পৃথিবীতে বাজার তৈরি করে সে ক্ষতি পুষিয়ে নিবো। অক্ষমের কী অদ্ভূত পিঁচুটি। এসব বালখিল্য কথায় কোনো লাভ হয়নি। বাজার সঙ্কুচিত হতে হতে বর্তমান পর্যায় নেমে এসেছে। ফলে গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কেবলই হ্রাস পাচ্ছে। শেয়ার বাজারে ৩৩ লক্ষ প্রান্তিক বিনিয়োগকারীর প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা কারসাজি করে হাতিয়ে নিয়ে গেছে। সরকার তাদের ধরার বদলে কোলে নিয়ে লালন করছে।
দ্রব্যমূল্য বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য আকাশ ছুঁয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যতই বলেন, দাম কমিয়ে একেবারে মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে এসেছেন। সেসব কথা লোকে শোনে বটে, কিন্তু সম্ভবত এ ধরনের বক্তব্যে তারা করুণাই করে। খুশি হয় না। তিনি পয়সা দিয়ে লোকজন জড়ো করে এমন অমৃত বচন যখন শোনান, তখন টিভি ক্যামেরায় তাদের ম্লান মুখ প্রধানমন্ত্রীর চোখে পড়ে না। কিন্তু তা জনসাধারণের দৃষ্টি এড়ায় না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়িয়েছেন। কিন্তু বিদ্যুৎ থাকে না। এই লিখতে বসেছি, বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘণ্টা-দেড় ঘণ্টা পর হয়তো আবার আসবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ঘরে ঘরে চাকরি দেবেন। বিদ্যুতের অভাব দূর হয়ে যাবে। কৃষককে বিনামূল্যে সার দেওয়া হবে। প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করা হবে। দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনা হবে। আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতির স্বর্ণযুগের সূচনা হবে। মানুষ যা কিছু কল্পনা করতে পারে, তার সবকিছু তিনি তাদের হাতে তুলে দেবেন। কিন্তু বাস্তবে আমরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্রই দেখতে পাচ্ছি। তাতেও সরকারের সিনাজুরির কমতি নেই। কিছু অশিক্ষিত লোক এখন আওয়ামী মুখপাত্র। তাদের কথা শুনলে ঘৃণায় গা রি রি করে ওঠে। জনগণ নিদারুণ অসহায় অবস্থায় পড়েছে। কোথায়ও কোথায়ও সরকারি দল নিজেই ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নিষ্কম্প হাতে তারা মানুষ খুন করছে। গুম করছে।
উপরন্তু যে ইসলাম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি, তার নিশানা মুছে দেওয়ার সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা তারা তুলে দিয়েছে। এখন ইসলামের মৌল নীতিগুলোতেও পরিবর্তন আনার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। আমরা জানি যে, কোনো মুসলমান ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে বিয়ে করতে পারে না। আগে তাদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। সরকার সে বিধান পরিবর্তন করে এখন ব্যবস্থা করেছে যে, যার যার ধর্মে থেকেও বিয়ে করা যাবে। আর এজন্য নিয়োগ করা হয়েছে হিন্দু কাজী। যারা মুসলমানের বিয়েও পড়াতে পারবে। বিয়ে রেজিস্ট্রেশনটা আইন। কিন্তু বিয়ে পড়ানো ধর্মের বিধান। হিন্দু কাজী কেমন করে কি খুতবা ও দোয়া-দরুদ পড়ে মুসলমানের বিয়ে সম্পাদন করবেন। সরকারের এসব কার্যক্রম অকারণে মুসলমানের ধর্ম ও ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করার শামিল। কিন্তু নিষ্কম্প চিত্তে সরকার এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের কর্তব্য হলো সর্বশক্তি দিয়ে এখনই এই সরকারকে প্রতিহত করা। সে সংগ্রামে জয় আমাদের অবধারিত।

বৃহস্পতিবার, ৩ মে, ২০১২

ঘোর অনিশ্চয়তায় যাত্রা



॥ ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ॥

শেখ হাসিনার লগি-বৈঠা আন্দোলনের ফসল হিসেবে যখন এ দেশে মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীন গং রাষ্ট্রমতা দখল করে নেয়, তখন লিখেছিলাম বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘোর দুর্দিন আর কখনো আসেনি। বাংলাদেশের অস্তিত্ব এতটা বিপন্ন আর কখনো হয়নি। বহু লেখায় সে সম্পর্কে পাঠককে অবহিত করার চেষ্টা করেছিলাম। ওই অসাংবিধানিক সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিবাদ উচ্চকিত করে তোলার চেষ্টা করেছিলাম। আওয়ামী লীগ যখন ওই সরকারকে দুই হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানাল এবং শেখ হাসিনা ঘোষণা করলেন যে, ওই সরকার বিএনপিকে শায়েস্তা করে দিক। ভবিষ্যতে তাদের এসব কর্মকাণ্ডকে আওয়ামী লীগ সাংবিধানিক বৈধতা দেবে। তখন প্রমাদ গুনেছিলাম।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি (১/১১) সরকার মতাসীন হওয়ার পরই বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যাপক সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করতে শুরু করে। তাতেও আওয়ামী লীগ খুব বগল বাজিয়েছে। সোৎসাহে অবিরাম বলে গেছে, বিএনপির লোকেরা ল কোটি টাকা দুর্নীতি করেছে। তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হোক। মইন-ফকরের সরকার শুরুও করেছিল তাই। হাজারে হাজারে বিএনপির নেতাকর্মীকে নির্যাতন ও গ্রেফতার করে কারাবন্দী করছিল। আদালত থেকে জামিন পেয়ে, জেল থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে নিলেই জেলগেটেই আবার নতুন মামলা দায়ের করে জেলে পোরা হচ্ছিল।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উৎসাহ তাতে বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়ে গিয়েছিল। ওই অসাংবিধানিক সরকারকে মতায় আনার পেছনে ষড়যন্ত্র করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসঙ্ঘ ও তাদের বশংবদ অন্য সব সংস্থা। এরা মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও গণতন্ত্র পূজারী এরা নয়। নিজেদের স্বার্থে স্বৈরশাসন, সামরিক শাসন সবই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। ফলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। তখনো এ দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় অসাংবিধানিক প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমদ। মতায় আসীন হওয়ার কিছুকাল পরই ভারত সফরে গিয়েছিলেন তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান স্বঘোষিত জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। ভারত সরকার তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বাগত জানিয়েছিল। তারা ঘোষণা করেছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের জন্য এত বড় বন্ধু তারা কোনো দিন পাননি। 
এতে জনবিচ্ছিন্ন ব্যাঙ-মইন ফুলে হাতি হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। জনমত সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণাও ছিল না। এ রকম চেষ্টার ফলে তার পেটটা যে ফটাশ করে ফুটে তিনি অক্কা পেতে পারেন এ ধারণাও তার কখনো হয়নি। আর মতার স্বাদ পেয়েই এই মতা চিরস্থায়ী করার একটা সাধ তার মনে উপ্ত হয়ে উঠেছিল। তার সামান্য বুদ্ধিতে তিনি বুঝেছিলেন, মতায় যদি স্থায়ীভাবে থাকতে হয়, তাহলে রাজনীতিকদের নির্মূল করে ফেলতে হবে। আর তাই শুধু বিএনপি নয়, তার খড়গ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও উত্তোলিত হতে থাকে। সেটি কতটা লোকদেখানো ছিল কিংবা তার পেছনে কতটা লোভ ছিল অথবা আওয়ামী লীগের সাথে কী আয়োজন ছিল; সেটি বলতে পারি না। কিন্তু আমরা ল করেছি, বিএনপি নেতাদের পাশাপাশি শেখ হাসিনা যে কত বড় দুর্নীতিবাজ সেটি প্রমাণ করার জন্য নানা জবরদস্তিমূলক আয়োজন তিনি করে যেতে থাকেন।
আওয়ামী লীগের হত্যা আর সন্ত্রাসের রাজনীতি দেশকে এমন অচল অবস্থার দিকে নিয়ে গিয়েছিল যে, জেনারেল মইন গংয়ের আগমনে প্রাথমিকভাবে মানুষ খানিকটা স্বস্তিবোধ করেছিল। কিন্তু অচিরেই জনগণ টের পেল যে, রাষ্ট্রপরিচালনায় তারা সর্বৈব ব্যর্থ। দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকল হু হু করে। ভারতের অসঙ্গত দাবির কাছে নতি স্বীকার করলেন জেনারেল মইন। এ দেশের স্বার্থ কিংবা সার্বভৌমত্ব, কোনোটির প্রতি তিনি মোটেই শ্রদ্ধাশীল নন। উপরন্তু রাজনীতিবিদদের শায়েস্তা করার জন্য সেনাবাহিনীর সদস্যদের যখন সেনানিবাস থেকে বাইরে বের করে আনল, তখন সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায় থেকে সাধারণ সিপাই পর্যন্ত অতি সাধারণ মানুষের ওপরও জোর-জুলুম-নির্যাতন শুরু করে দিলো। এক লাখ বন্দুক দিয়ে যে ১৫ কোটি ুব্ধ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, এটি উপলব্ধি করার মতা নির্বোধ মইনের ছিল না। 
অন্যান্য দেশের সামরিক শাসকেরা যা করে থাকে, জেনারেল মইন তার কোনো ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. ইউনূসকে দিয়ে তার অনুকূলে ‘সৎ মানুষের’ একটি রাজনৈতিক দল নাগরিক শক্তি গঠন করার চেষ্টা করলেন। এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের মদদ ছিল না, এমন দাবি করা যাবে না। বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাসহ উভয় দলের রাজনৈতিক নেতারা কারাবন্দী। এ সুযোগে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন হয়তো সম্ভব হতে পারে। কিন্তু ড. ইউনূসও জানতেন না যে, এ এক অসম্ভব প্রচেষ্টা। তার হয়তো ধারণা ছিল, গ্রামীণ ব্যাংকের সব সদস্য, সব ঋণগ্রহীতা ঝাঁকে ঝাঁকে তার দলে ছুটে আসবেন। 
কিন্তু সেটি হয়নি। দেখা গেল, যারা তার ঋণগ্রহীতা তারা সবাই বিএনপি বা আওয়ামী লীগের সমর্থক। ঋণ গ্রহণের দায়ে সে সমর্থন তারা কেউই পরিত্যাগ করতে চাইলেন না। বরং ই-মেইলে ও অন্যান্য মোবাইল বার্তায় সব মানুষ ড. ইউনূসকে এই অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাতে থাকেন। আশা একেবারেই ীণ দেখে ড. ইউনূস রণে ভঙ্গ দিলেন। হলো না তার রাজনৈতিক দল গঠন। তখন জেনারেল মইন নানা উপায় খুঁজতে শুরু করলেন। রাজনৈতিক দলগুলোর ঊর্ধ্বে নিজের মতা ধরে রাখার নানা কৌশলের কথা সময় সময় ঘোষণা করতে থাকে।
কিন্তু রাষ্ট্রপরিচালনায় তার ব্যর্থতায় অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সারা দেশের মানুষ ুব্ধ হয়ে উঠতে থাকল। তা ছাড়া সামরিক বাহিনীর একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও সদস্যের নির্যাতনের প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল দেশবাসী। স্বপ্নভঙ্গ হতে থাকল জেনারেল মইনেরও। আর যারা তাকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মতায় বসিয়েছিল, তারা বিবেচনা করে দেখল যে, একে দিয়ে হবে না। ভিন্ন কাউকে দরকার। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শোষণের ধারা যেন অব্যাহত থাকে, সেটিও তারা নিশ্চিত করতে চাইল। মইনের ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হলো। 
তবে তার পালানোর পথ কী? নিরাপদ প্রস্থান তো দরকার। সে েেত্র কোনো রাজনৈতিক দলের সহায়তা তাদের জন্য প্রয়োজন। দেশপ্রেমিক দল হিসেবে বিএনপির সাথে সে গাঁটছড়া যে বাঁধা যাবে না, সেটি মইনের প্রভুরা ও মইন নিজেও জানতেন। ফলে আবারো প্রাসাদ ষড়যন্ত্র জোরদার হয়ে উঠল। কোনো একটা লোকদেখানো নির্বাচনের মাধ্যমে যদি শেখ হাসিনাকে মতায় নিয়ে আসা যায়, তাহলে সাম্রাজ্যবাদী শাসন যেমন অটুট রাখা সম্ভব, আধিপত্যবাদীদের স্বার্থ যেমন নির্বিঘœ রাখা সম্ভব, তেমনি সেবাদাস জেনারেল মইন ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা যাবে। ফলে ষড়যন্ত্রকারীরা আওয়ামী লীগের সাথে গাঁটছড়া বাঁধল।
সেই নির্বাচনে ছলে-বলে-কলে-কৌশলে মইনের লুটেরা সহযোগীরা আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে আনার কৌশল নির্ধারণ করল। তাতে গোটা সেনাবাহিনী সহযোগিতা করল, কার্যত ভবিষ্যতে নিজেদের সুরার জন্য। আমরা শঙ্কিত ছিলাম। কিন্তু আমি গণক নই। ফলে তৎণাৎ এ কথা বলতে পারিনি যে, বাংলাদেশের জন্য আরো ভয়াবহ দুঃসময় অপেমাণ। সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির সেনাবাহিনী ও নির্বাচন কমিশন মিলে দেশে এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করল যে, বিএনপি ও সমমনা দলের লোকেরা যাতে নির্বাচনী বুথের কাছাকাছি না আসতে পারে। ফলে ব্যাপক জাল ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতিয়ে আনা হলো। ভোট কারচুপি আর জাল ভোটের েেত্রও এরা মিলে বাংলাদেশে এক ইতিহাস সৃষ্টি করল। কোথাও কোথাও ভোট পড়েছে ১০০ ভাগ। এমনকি ১০০ ভাগ ছাড়িয়ে ১০-১৫ ভাগ বেশি। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে এভাবেই বিএনপিকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার যাত্রার সূচনা।
আওয়ামী লীগ মতায় আসীন হওয়ার পরপরই উপলব্ধি করা গেল যে, কী এজেন্ডা নিয়ে এ আয়োজন সম্পন্ন করা হলো। সংবিধান তছনছ করে ফেলা হলো। বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ দলীয়করণ করে ফেলা হলো। প্রশাসন নির্লজ্জ দলীয়করণে অযোগ্য লোকদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ল। আওয়ামী লীগ সরকার শেখ হাসিনা ও তার দলের লোকদের নামে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হলো। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া ও তার দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মামলা তো বহাল রইলই; এরপর আওয়ামী লীগ সরকার নিজেরা আবার নতুন করে একের পর এক মামলা দায়ের শুরু করল। ভারত অর্ধশতাব্দী ধরে ট্রানজিট করিডোরের যে আবদার জানিয়ে আসছিল, গোপন চুক্তির মাধ্যমে সেগুলো বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেল। এ চুক্তির বিষয়বস্তু সাধারণ মানুষ এমনকি সংসদ সদস্যদেরও জানার অধিকার রহিত করা হলো। 
এখন নাৎসি কায়দায় ক্রসফায়ার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম পরিচালনা করছে সরকার। যে যাকে যেখানে খুশি খুন করছে কিংবা গুম করে ফেলছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনায় ভাসে লাশ। কৃষি েেত অচেনা মানুষের লাশ পড়ে থাকে। নারী-শিশু-বৃদ্ধ-যুবক কেউ এই হত্যার উৎসব থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন না। আর প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে শত শত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে মন্ত্রীরা সংবর্ধনা জানাচ্ছেন। তারা আবারো হত্যার উৎসবে মেতে উঠছে। বিরোধী দল নির্মূলে এমন কোনো হীন পদ্ধতি নেই যা সরকার ব্যবহার করছে না। গুমের ঘটনা অহরহ ঘটছে। সিটি করপোরেশনের কমিশনার চৌধুরী আলম গুম হওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের গুমের ঘটনা শুরু হয়েছে। গ্রামগঞ্জে বহু ছাত্র, কৃষক, রাজনৈতিক কর্মীকে র‌্যাব বা অন্য কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে হাওয়া করে দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে ১৭ এপ্রিল। গুম হয়েছেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক, দু’বার নির্বাচিত এমপি এম ইলিয়াস আলী। পুলিশের একজন এসআই, একজন নাইটগার্ড, একজন ডাব বিক্রেতাসহ আরো অনেকেই তাকে অপহরণের দৃশ্যটি দেখেছেন। র‌্যাব পরিচয়ে তাকে ও তার গাড়িচালককে অপহরণ করা হয়েছে। এখন সেসব প্রত্যদর্শীর কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার এর দায় সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। 
পৃথিবীর সব দেশেই স্বৈরশাসকেরা মতার মদমত্ততায় জনগণের শক্তির কথা ভুলে যায়। কিন্তু ইতিহাসের স্যা হচ্ছে পৃথিবীতে কোনো স্বৈরশাসকের শাসনই চিরস্থায়ী হয়নি। তাদের করুণ পরিণতি হয়েছে। কোনো পরাশক্তি শেষ পর্যন্ত তাদের রা করতে পারেনি। সাম্প্রতিক বিশ্বে তার উদাহরণ ইরাক-লিবিয়া-মিসর। মিসরের একনায়ক হোসনি মোবারকের প্রতি সব পশ্চিমা প্রভু সমর্থন জুগিয়েছিল। কিন্তু জনতার প্রতিরোধে সে শাসন, সে নির্যাতন নৃশংসতার অবসান ঘটেছে। তারা এখন কারাবন্দী। এমনকি শেখ হাসিনার পূর্বসূরি স্বৈরশাসক জেনারেল মইনকে মতা ছাড়তে হয়েছে। 
বাংলাদেশের এখন ঘোর দুর্দিন। সরকারের নির্যাতন, নিপীড়ন সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে কত কী করছে সরকার। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে এখন অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের মামলা দায়ের করা হয়েছে। তারা যেন আদালতে জামিন আবেদন না করতে পারেন, সে জন্য আদালতে যুদ্ধেেত্রর মতো নিñিদ্র প্রহরা নিশ্চিত করা হয়েছে। তবু এ কথা বোধ করি নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, এ দিয়ে বর্তমান সরকারের শেষ রা হবে না। আর এই ধারা অব্যাহত থাকলে তাদের পরিণতি অন্য সব স্বৈরশাসকের মতো করুণ হতে বাধ্য। 
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com