শনিবার, ১৬ জুন, ২০১২

এখন প্রতিদিন কালো দিবস

এখন প্রতিদিন কালো দিবস



॥ ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ॥

১৯৭৫ সালের ১৬ জুন বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজের জন্য এক ভয়াবহ দুর্যোগের দিন হিসেবে হাজির হয়েছিল। ওই দিন শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সর্বময় মতার অধিকারী হিসেবে সংবাদপত্রের ডিকারেশন বাতিল অধ্যাদেশ জারি করে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছিলেন। ১৯৭২-৭৫ সালের প্রায় সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশের ইতিহাস এক ভয়াবহ স্বৈরাচার আর দুঃশাসনের সময়। রীবাহিনী গঠন, মধ্যরাতের সাদা জিপ, তাদের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, খুন, গুম শেখ মুজিবুর রহমানের এই শাসনকালে বাংলাদেশের জনপদকে এক আতঙ্কের জনপদে পরিণত করেছিল। 
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের এক প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ দলের যে বিপুল বিজয়, সেটা তার ব্যক্তিগত ক্যারিশমা আর ইমেজ থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল। এ কথাও সত্য, ওই নির্বাচনের পর থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে যা হতে বলতেন, নিশ্চিতভাবে তাই হতো। আমরা যারা মওলানা ভাসানীর ধর্মভিত্তিক বাম রাজনীতির সাথে ছাত্রজীবনে বেড়ে উঠছিলাম, তাদেরও বলতে দ্বিধা নেই, শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণাকে জাতির ঘোষণা বলে মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু ১৯৭১ সালে মতা হস্তান্তরের আলোচনা যখন চলছিল, তখনো আমরা আশাবাদী ছিলাম, শেখ মুজিবুর রহমানই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছেন। এমনকি জেনারেল ইয়াহিয়া খান পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার জেনারেলদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাদ সেধেছিলেন পশ্চিম 
পাকিস্তানের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি কিছুতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। এ দিকে আবার শেখ মুজিবুর রহমানও সর্বপাকিস্তানীয় রাজনীতিবিদ হিসেবে কিছুতেই পরিচিত ছিলেন না। জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপিপিও না। ফলে তিনি একজন প্রাদেশিক নেতার মর্যাদাই কেবল লাভ করেছিলেন। সর্বপাকিস্তানীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেননি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সম্ভবত দুয়েকজন প্রার্থী দিয়েছিল। পিপিপির েেত্রও বোধ করি এ কথা সত্য। পশ্চিম পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমান পরিচিত নাম ছিলেন না। পূর্ব পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর কোনো সমর্থক ছিল না। জেনারেল ইয়াহিয়া খান অত্যন্ত সরল বিশ্বাসে জনসংখ্যার ভিত্তিতে জাতীয় সংসদের আসন নির্ধারণ করেছিলেন। তাতে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য আসন সংখ্যা কম হয়েছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কিংবা খাজা নাজিমুদ্দিন অথবা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পাকিস্তানের উভয় অংশে যতটা গ্রহণযোগ্য ছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান বা জুলফিকার আলী ভুট্টো তার কিয়দংশও ছিলেন না। বিপত্তিটা সম্ভবত সেখানেই বেধেছিল। 
শেখ মুজিবুর রহমান সম্ভবত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। এর বিভক্তি তিনি চাননি। তার বহু প্রমাণ সাম্প্রতিক কথামালায় লিপিবদ্ধ আছে। পাকিস্তানে বন্দিদশায় শেখ মুজিবুর রহমান জানতেনও না যে, কী অবিস্মরণীয় ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে এ দেশের নেতৃবৃন্দ ভালবেসে রামের খড়মের মতো সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে রেখেছিল। সে কারণেই তিনি লন্ডনে বিবিসির সিরাজুর রহমানকে বলেছিলেন, সেখানকার লোকেরা তাকে এক্সসেলেন্সি বলছে কেন? সিরাজুর রহমানই তাকে প্রথম খবর দেন যে, বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এবং তিনি সেই স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি। 
পাকিস্তানের এই দ্বিখণ্ডিত হওয়া তিনি পছন্দ করেছিলেন কি না বলতে পারি না। কিন্তু তিনি বাংলাদেশে ঢুকেই এ দেশের রাষ্ট্রপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। তার পরের কাহিনী শেখ মুজিবুর রহমানের ভারসাম্যহীন শাসনের কাল। শেখ মুজিবুর রহমান অল্প কিছু দিন প্রেসিডেন্ট থেকে মতার অভীপ্সায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বময় মতা গ্রহণ করেন। তার অপশাসন, দুঃশাসন, দলীয়করণ, তার দলের লোকদের সীমাহীন দুর্নীতি দেশকে প্রায় ঝাঁজরা করে ফেলে। কেন শেখ মুজিবুর রহমান সানন্দে এই সব অপকর্ম সম্পাদন হতে দেন, তাও বিবেচ্য বিষয়। একপর্যায়ে তিনি তার দলীয় লোকদের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতে শুরু করেন। তার অপশাসনের জন্য যারা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরোধিতা করতে শুরু করল, আকস্মিকভাবেই তিনি তাদের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়ে দিলেন। তারপর কেন জানি না, সেনাবাহিনীর বিকল্প হিসেবে তিনি রীবাহিনী গঠন করলেন। 
বাংলাদেশের ইতিহাসে রীবাহিনীর নির্যাতন আর বর্তমান সরকারের আমলে র‌্যাবের কার্যকলাপ প্রায় একই পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। রীবাহিনী ছেলেকে হত্যা করে বৃদ্ধ বাপকে তার মাথা কেটে দিতে বাধ্য করেছে। তারপর তারা সেই কর্তিত মুুণ্ডু নিয়ে মাঠে ফুটবল খেলেছে। শাসকেরা হয়তো সয়। কিন্তু আইনস্টাইনের ভাষ্য অনুযায়ী প্রকৃতি সরলতা পছন্দ করে এবং শূন্যতা পরিহার করে। শেখ মুজিবুর রহমানের এই তত্ত্বজ্ঞান ছিল কি না, সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু যখন তিনি আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে একদলীয় স্বৈরশাসন চালু করেন, তখনো তিনি বিরুদ্ধ সব মত স্তব্ধ করে দেয়ার প্রয়াসেই তা করেন। এগুলো ফলদায়ী হয়নি। এবং আশ্চর্য এই যে, যখন তিনি সর্বময় মতার অধিলিপ্সায় একদলীয় স্বৈরশাসন চালু করেন, তখন সংবাদপত্রে তার একটি ছবি ছাপা হয়েছিল, তিনি তার ড্রয়িংরুমে বসে লেনিন রচনাবলি পড়ছেন। এ ছবি ছাপা হওয়ার পর অনেকেই হেসেছেন। অনেকের জন্য কিছুই বলার ছিল না। শেখ মুজিব সমর্থকেরাও তার পদেেপ কেমন যেন বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। এ কেমন স্বদেশ! শেখ মুজিব দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন!
তখন গোটা দেশ এক ভয়াবহ আতঙ্কে। দেশে দুর্ভিরে সৃষ্টি হয়েছে। সরকার সমর্থক মন্ত্রী-এমপি-আমলারা ‘আঙুল ফুলে বটগাছ’ হয়েছেন। দুর্ভিে লাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান কেন যেন ভয়াবহভাবে নির্বিকার ছিলেন। এ রকম সময়ে তার ছেলের বিয়েতে লোকেরা সোনার মুকুট উপহার দিয়েছে। তিনি সহাস্য বদনে তা গ্রহণ করেছেন। এক দিকে পথে পথে লাশের সারি, ুধার্ত মানুষের আর্তচিৎকার, অন্য দিকে স্বর্ণের মুকুট। জনগণ বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। শেখ মুজিব বলে কথা। তখন সংবাদপত্রকে নির্দেশ দেয়া হলো, দুর্ভি বা অনাহারে কেউ মারা গেছে, এমন কথা কিছুতেই লেখা যাবে না। আঞ্জুমানমফিদুল ইসলাম প্রতিদিন শত শত বেওয়ারিশ লাশ দাফন করছে, সংবাদপত্রে তা প্রকাশ করা যাবে না। 
তবে সংবাদপত্রে কী প্রকাশ করা যাবে? দেশের সংবাদপত্র তখন এর চিত্র ছিটেফোঁটা প্রকাশ করতে শুরু করল। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো যে, একজন ুধার্ত মানুষ অন্য একজনের বমি থেকে ভাত তুলে খাচ্ছিলেন। একইভাবে দুর্ভিে মৃত্যু হয়েছে এই কথাটি শুধু লেখা হচ্ছিল না বটে, কিন্তু অনাহারে মৃত্যুর খবর প্রতিদিন বাড়ছিল। আঞ্জুমানমফিদুল ইসলাম প্রতিদিন কতসংখ্যক অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ দাফন করছিল, তার হিসাব প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে প্রতিদিন ছাপা হচ্ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে দুর্ভিরে শিকার ছিলাম। কিন্তু যারা শিকার ছিলেন না, তারাও আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। 
এর কিছু না কিছু সংবাদ প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছিলই। শেখ মুজিব যেন এর কোনো কিছুই সহ্য করতে পারছিলেন না। সুরম্য প্রাসাদে বসে তার মনে হচ্ছিল, এ সব কিছুই বাড়াবাড়ি। অতএব সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। আর সে ইচ্ছা পূরণ করার জন্যই ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার তার গুণগান গাওয়ার জন্য দেশে মাত্র চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকি সব সংবাদপত্রের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে দেন। এ দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের এই সিদ্ধান্ত ছিল অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য। 
এখন কেউ কেউ এমন যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করছেন যে, একদলীয় সরকারের সাথে বহুসংখ্যক সংবাদপত্র যায় না বলেই শেখ মুজিবুর রহমান সংবাদপত্র ডিকারেশন বাতিলের অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। অর্থাৎ মতা নিরঙ্কুশ হবে। শেখ মুজিব যা কিছু অনাচার-অত্যাচার করেন না কেন, তার বিরুদ্ধে কোনোরূপ প্রতিবাদ করা যাবে না। জনগণের আকাক্সা! বিস্ময়করভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে তার মূল্য শূন্যের কোঠায় গিয়ে দাঁড়াল। 
তার আগে সংবাদপত্র দলনে হেন কোনো ইতর ব্যবস্থা নেই, যা শেখ মুজিবুর রহমান সরকার গ্রহণ করেনি। পত্রিকার সাব-এডিটর থেকে শুরু করে সম্পাদক পর্যন্ত কেউ তার সেই দলন-পীড়ন থেকে রেহাই পাননি। ডেইলি অবজারভার পত্রিকার সহসম্পাদক বাবুল রাব্বানী সে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। নির্যাতনের শিকার হয়ে জেলবন্দি হয়েছিলেন দৈনিক গণকণ্ঠের সম্পাদক দেশের প্রথিতযশা কবি আল মাহমুদ, সাপ্তাহিক হলিডের সম্পাদক মরহুম এনায়েতুল্লাহ খান, স্পোকস্ম্যান/মুখপত্র সম্পাদক ফয়জুর রহমান। এ ছাড়া ইস্টার্ন এক্সামিনার সম্পাদক, মওলানা ভাসানী প্রকাশিত হককথার সম্পাদক এরাও শেখ মুজিবুরের গরাদে বন্দী জীবনযাপন করেছেন। 
সেই দুঃসহকাল আবার ফিরে এসেছে। পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী, সরকারের দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহের দায়ে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুন হয়েছেন। সরকারি মাস্তানেরা প্রতিনিয়ত সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। কোনো কোনো দালাল এসব নিয়ে এলোমেলো কিছু কথাবার্তা বলছে। কিন্তু নিগ্রহ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সম্প্রচার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, টেলিভিশনের টক শোগুলো ভারি টক। এবং তারা অন্ধ। সরকারের কোনো উন্নতিই তারা দেখতে পায় না। ফলে টক শোগুলোতে এখন প্রিয় মানুষের মুখ দেখা যাচ্ছে না। এভাবেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হচ্ছে। কিন্তু প্রতিরোধও সর্বব্যাপী। সাংবাদিকেরা একেবারে চুপ করে থাকেননি। শেখ হাসিনা সরকারের পে শেখ মুজিবের মতো হয়তো সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয়। ধারণা করি, আরো নিগ্রহ অপেমাণ। 
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন