ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী :
সরকার এখন কে চালাচ্ছে, কে কখন কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সেসব ধুলায় অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রীদের কথার মধ্যেও কোনো সাজুয্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এক মন্ত্রী যদি বলেন, উত্তরে যাচ্ছি, আর একজন বলেন, দক্ষিণে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, দেশ বিদ্যুতে সয়লাব হয়ে গেছে। আবার প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টা বলেছেন, আগামী কয়েক বছরে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের কোনো সম্ভাবনাই নাই। কিন্তু সাধারণ মানুষ বিদ্যুতের দেখা পাচ্ছে না। তারা মিছিল, মিটিং, সভা, অবরোধ, ভাংচুর করছে। কোনো কোনো মন্ত্রী দাসানুদাস বিবেচনায় জনগণকে কষে গাল দিচ্ছেন। তারা যদি এরকম করতেই থাকে তাহলে যেটুকু বিদ্যুৎ দেয়া হচ্ছে সেটাও বন্ধ করে দেবে। মনে হয়, জনগণ তাদের ভাগ্য নিয়ন্তা নয়, ক্রীতদাস মাত্র। তাদের এসব বাড়াবাড়ি মহারাজ সরকার সহ্য করবে কেমন করে? টেলিভিশনে যারা টকশো করেন, কিংবা সভা-সমাবেশে যেসব সুধীজন জনগণের মতামত প্রতিফলন ঘটিয়ে বক্তব্য দেন, তাদের উপরও সরকার দারুণ খাপ্পা। প্রধানমন্ত্রী হুমকি দিয়েছেন, এক সপ্তাহ তাদের বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে হবে।
বিদ্যুতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পানির সমস্যা। বিশাল বিশাল এলাকা ও জনপদের গোটা অঞ্চলেই পানি নেই। গত কয়েকদিন ধরে তেজগাঁওয়ের শিল্পাঞ্চল পানিশূন্য। নগরীর অধিকাংশ এলাকায় পানির জন্য হাহাকার। মানুষ বিক্ষোভ করছে। মিছিল করছে। সরকারের দলীয়করণকৃত পুলিশ বাহিনী তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বিদ্যুৎ-পানি থাকতেই হবে এমন কি কোনো কথা আছে। নাই তো নাই। সরকার চেষ্টা করছে। সে চেষ্টায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুতের সমস্যা মিটাতে অর্থনীতিখেকো রেন্টাল পাওয়ারের আয়োজন করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, সেখান থেকে সরকারের লোকেরা চল্লিশ হাজার কোটি টাকা ইতোমধ্যে লুট করে নিয়েছে। এখন সেগুলোও অচল হয়ে পড়ছে। পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, রেন্টাল পাওয়ার স্টেশনগুলো চালালে এর মালিকদের যা লাভ, না চালালে তারচেয়েও বেশি লাভ।
এদিকে এগুলো সচল রাখার জন্য আমদানি করা হচ্ছে অতিরিক্ত শত শত কোটি টাকার জ্বালানি তেল। তাতে ভর্তুকি বিপুল। কন্টাক্ট-পাওয়া সরকারি লোকদের দুর্নীতির খাই মেটাতে জ্বালানি তেলের দাম প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে। নতুন বাসা বাড়িতে গ্যাস বিদ্যুতের সংযোগ না দেয়ায় হাউজিং কোম্পানিগুলো মাথায় হাত দিয়ে বসেছে। এদিকে আবার ভারতীয় ‘প্রতারক' কোম্পানি সাহারাকে উপশহর গড়ে দেয়ার জন্য এক লাখ একর জমি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশীয় আবাসন শিল্প মালিকরা। তারা বলছেন, জমি দিয়ে তারাই এমন উপশহর গড়ে তুলতে সক্ষম। ধরা যাক, সাহারা এই জমিতে উপশহর গড়ে তুলল। তাদের গ্যাস-বিদ্যুৎ কে দেবে? হয়তো সরকারই দেবে। দেশীয় শিল্প লাটে উঠবে।
এদিকে আবার এসব শিল্প ঘিরে গড়ে উঠেছে বহু সংখ্যক সাব-সিডিয়ারি শিল্প। যেমন: অ্যালুমিনিয়াম প্ল্যান্ট, উচ্চমানের কাঁচ শিল্প। এসব শিল্পে বাংলাদেশের শ্রমিকরা কাজ করে। অথচ সাহারা গ্রুপ তাদের সকল নির্মাণসামগ্রী নিয়ে আসবে ভারত থেকে। এমনকি ভারত থেকে আসবে লাখ লাখ শ্রমিকও। তাতে বাংলাদেশের লোকেরা কুলি-মজুরের কাজও পাবে কিনা সন্দেহ আছে। ভারতের সঙ্গে দ্বিগুণ সুদে ভারতের স্বার্থে যে শতকোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে তার শর্তগুলোও এমনই। এর সকল উপকরণ ভারত থেকে আমদানি করতে হবে এবং ভারতই এসবের মূল্য নির্ধারণ করবে। প্রতিযোগিতা মূল্যে বাইরে থেকে কিছুই কিনতে পারবে না বাংলাদেশ। তাতে যে ভারত দুই টাকার মাল দশ টাকা বলবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু বাংলাদেশ এর প্রতিবাদও করতে পারবে না। অর্থাৎ বিশ কোটি ডলার দিয়ে বাকি আশি কোটি ডলার ভারত আগেই গাপ করে দিতে পারবে। তারপর বাংলাদেশকে ঐ একশ' কোটি ডলার সুদসমেত প্রায় দেড়শ' কোটি ডলার শোধ করতে হবে। কী আজব তামাশা! এই নির্মাণ কাজের সকল দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকও আসবে ভারত থেকেই। বাংলাদেশের লোকেরা বড়জোর কুলি মজুর হবে।
সাহারা যদি উপশহর নির্মাণ করেও তাহলে বাংলাদেশে তা কেনার লোকের অভাব হবে। তখন সরকার সম্ভবত জনগণকে না জানিয়েই আইন করবে যে, ভারতীয়রা সে ফ্ল্যাট কিনতে পারবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে এখানে ভারতে স্থায়ী উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে।
দেশের শিল্পকারখানা নিয়েও সরকার তেলেসমাতি চালিয়ে যাচ্ছে। শিল্পকারখানায় গ্যাস-বিদ্যুৎ নেই। সরকার ঘোষণা করেছে চার টাকার বিদ্যুৎ শিল্পমালিকরা যদি ১৫ টাকায় কিনতে রাজি থাকেন, তাহলে তাদের নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ দেয়া হবে। তাতে বাংলাদেশে উৎপাদিত শিল্পপণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়াবে। এই ফাঁকে ভারত দখল করে নেবে বাংলাদেশের বাজার। বন্ধ হবে দেশীয় শিল্প। বেকার হবে লাখ লাখ শ্রমিক। এর বিপদ সম্পর্কে ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা সম্ভবত কিছুই আঁচ করতে পারছে না। দেশে যখন কর্মসংস্থান বন্ধ হবে, আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হবে। তখন লাখ লাখ মানুষ ভারতের দিকেই ধাবিত হবে। যে ভারতের আশি কোটি লোকের আয় দৈনিক বিশ-বাইশ রুপি, যেখানে ৭০ কোটি লোকের পায়ে জুতো নেই, নেঙটি পরে চলে, যেখানে সমপরিমাণ লোক খোলা জায়গায় প্রাকৃতিক কাজ সম্পাদন করেন, সেখানে আরও লাখ কর্মপ্রার্থী নতুন করে যুক্ত হলে ভারতের অর্থনীতি কী ভয়াবহ চাপের মুখে পড়বে সেটা অনুধাবন করার শক্তি সেখানকার আধিপত্যবাদী সরকারের নেই বলেই মনে হচ্ছে।
এদিকে বেপরোয়া দলীয়করণের ফলে প্রশাসন এবং রাষ্ট্রের স্তম্ভগুলো মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তারা পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। বিচারক রাস্তার মধ্যে পুলিশকে কান ধরে উঠবস করিয়েছেন। পুলিশ গত রোববার এক বিচারককে লাঠিপেটা করেছে। তার আগে প্রশাসন ক্যাডারের লোকদের পুলিশ বেধড়ক পিটিয়েছে। এক বিচারক সংসদের স্পিকারকে অশিক্ষিত ও রাষ্ট্রবিরোধী বলে উক্তি করেছেন। সংসদ সদস্যরা তার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ঐ বিচারককে অধিশংসনের দাবি জানিয়েছেন। স্পিকার সম্ভবত ঠিকই বলেছেন যে, সর্বত্র একটা ‘কী যেনো হনুরে ভাব'। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে মনে হয়েছে, তিনি জাতীয় সংসদের নয়, পুলিশ ও বিচারকদের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। কারণ তাদের মাধ্যমে বিরোধী দল দমনে অনুকূল ব্যবস্থা নেয়া রায় পাওয়া সম্ভবত তার জন্য সহজ। আমরা লক্ষ্য করেছি, সাধারণের দৃষ্টিতে বিবেচ্য বিষয় নয়, এমন বিষয়ে আদালত উপযাচক হয়ে রায় দিয়েছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীরা সেসবের তীব্র সমালোচনাও করেছেন।
এমনি একটা পরিস্থিতিতে সরকারকে বিরোধী দল নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য ১০ জুন পর্যন্ত আলটিমেটাম দিয়েছিল। এমনকি মহাজোট সরকারের মিত্ররা পর্যন্ত মনে করেন যে, একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া দরকার। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক মুন সিনেমা হলের মালিকানা ফেরতের মামলায় সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণতহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা ত্রাণ গ্রহণকারী এই খায়রুল হকই অসাংবিধানিক বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেন। যদিও তিনি তার রায়ে বলেছিলেন যে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পরবর্তী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে পারে। এই রায় হাতে পাওয়া মাত্রই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য জামায়াতে ইসলামীর হাত ধরে শেখ হাসিনাই রাষ্ট্রধ্বংসী আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। আর তাতেই শেষ পর্যন্ত বিএনপি ১৯৯৬ সালে ক্ষণস্থায়ী সংসদে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রণয়নে বাধ্য হয়।
এখন সেই সরকারব্যবস্থারই তুমুল নিন্দা করে তা আর পুনঃপ্রবর্তন না করার পক্ষে মুহুর্মুহু বক্তব্য রেখেছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, আগামী নির্বাচন দলীয় আওয়ামী লীগের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। তাই যদি হয় তাহলে সে নির্বাচনে বিএনপি বা জামায়াতের মতো শক্তিশালী দলগুলোর অংশগ্রহণের কোনো প্রশ্নই উঠে না। আওয়ামী লীগের দীর্ঘকালের মিত্র হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ আশা করছেন যে, ঐ নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশ গ্রহণ না করে, তবে তিনিই হবেন প্রধান বিরোধী দল। সে কারণেই তিনি ভারতের পরামর্শে সরকারের বিরুদ্ধে দু'চার কথা বলতে শুরু করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্ব বলছে যে, সকল দলের অংশগ্রহণে তারা এদেশে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠান দেখতে চায়। প্রধান সকল দল অংশ না নিলে সে নির্বাচন কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এগুলোকে আওয়ামী লীগ ভারতপ্রীতির কারণে কোনোভাবেই আমলে নিচ্ছে না। ভারতও নিজস্ব স্বার্থে সবসময় তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে। এখন তারা বলছে, যেকোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকে তারা রক্ষা করবে। এ কথা তারা ১/১১-তে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় আরোহনকারী জেনারেল মইনের ক্ষেত্রেও বলেছিল। জেনারেল মইনকে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা দিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে তারা বলেছিল যে, বাংলাদেশে ভারতের এতবড় বন্ধু কখনও আসেনি। কিন্তু জেনারেল মইন যখন ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেন, তখন ব্যবহৃত টিস্যু পেপারের মতো ভারত তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। সে লক্ষণ এখন অস্পষ্ট নয়। শেখ হাসিনার কাকা ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশে এসে কোনোদিন বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎও করেননি। সেই প্রণব এবার এসে সাক্ষাৎ তো করেছেনই, এবং বলেছেন, ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব চায়। কোনো দলের সঙ্গে নয়। এসব বার্তার মর্মার্থ চরম ব্যর্থ সরকার উপলব্ধি করতে পারে কিনা জানি না।
এর আগে সারাদেশে সফল রোডমার্চ কর্মসূচি শেষে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল গত ১২ মার্চ ঢাকায় মহাসমাবেশ ডেকেছিলেন। এই মহাসমাবেশকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য সরকার এক সপ্তাহ আগে থেকেই সারাদেশকে ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। ঢাকার সঙ্গে সমস্ত সড়ক, নৌযোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ঢাকা মহানগরীর সমস্ত হোটেলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তারা যেন নতুন কোনো বোর্ডারকে থাকতে না দেন। মানুষ অবর্ণনীয় দুর্দশার শিকার হয়েছিল। এবার বিএনপির নেতৃত্বাধীন আঠারো দলীয় জোট ১০ জুনের মধ্যে নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে না নিলে ১১ জুন ঢাকায় গণসমাবেশের ডাক দেয়। ধারণা করা হয়েছিল, সরকার সম্ভবত এবার আর কোনো বাধা দেবে না। নির্বিঘ্নে গণসমাবেশ হতে দেবে। কিন্তু ১০ জুনই সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এবং আবারও ঢাকামুখী সড়ক-নৌপথের সকল যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। হোটেলগুলোতে আগের মতোই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সরকার এখন মনে করছে, জনগণই এখন তাদের শত্রুপক্ষ। জনগণ যদি শত্রুপক্ষ হয়, তাহলে ক্ষমতায় থাকার উপায় কী? কূটকৌশল? এগুলো শেষ পর্যন্ত ফলদায়ী হয় না। চূড়ান্ত বিচারে জনগণই জয়ী হয়। সরকারের সে উপলব্ধি হলে ভাল হতো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন