মঙ্গলবার, ৩ জুলাই, ২০১২

একে একে নিভিছে দেউটি



ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : 
বাংলাদেশ সম্ভবত পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ দেশ। কবি হেলাল হাফিজের মতো বাংলাদেশে সম্ভবত এটাও উপলব্ধি করার ক্ষমতা নাই যে, তাদের কেহ নাই, কিছু নাই। সত্তরের দশকে কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন যে, ‘আগুনে পোড়ালে তবু কিছু থাকে,/হোক না তা ধূসর মলিন ছাই,/মানুষে পোড়ালে আর কিছুই থাকে না,/আমার কেহ নাই, কিছু নাই।' যে ইস্যুতে লিখতে যাচ্ছি, সেখানে এই কবিতাটি যে খুব একটা খাপ খায়, তা নয়। এই সরকারকে ভালবেসে ক্ষমতায় এনেছিল যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, ইউএনডিপি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ভারত, সবাই মিলে। এখন তাদের বিদায়ের পালা শুরু হয়েছে। সরকারের দেউটি একে একে নিভে যাচ্ছে। শুধুমাত্র ভারতের পিদিম ছাড়া এই সরকারের আশপাশে আর যে কেহ নাই, কিছু এটি বুঝবার ক্ষমতা এই সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ, এমনকি এমপি, কারো নাই। এরা শেয়ালের মতো প্রধানমন্ত্রীর অবিবেচনাপ্রসূত বক্তব্যের সঙ্গে রা ধরে কেবল সায় দিয়ে যান। এদের কারো কোথায়ও কোনো ব্যক্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় না।
এই সরকারের ভেতরে কোনো স্বাধীন কণ্ঠস্বর নেই। সংসদে একটা বিল পাস হয় উত্থাপন মাত্রই। এর অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করার মতো কোনো যোগ্যতা কারো নেই। অন্তত আমরা দেখিনি। ফলে ষোলকোটি মানুষের দেশ আজ ভয়ানক বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এই সরকারের পা চাটা ভারতনীতির কারণে এদের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের সম্পর্কের ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। কিন্তু এই অবনতিকে সরকার দু'পয়সারও গুরুত্ব দেয় না। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি দেশ থেকে প্রতিদিন সেখানকার কর্মরত বাংলাদেশীদের বিনাকারণেই ফেরত পাঠানো হচ্ছে। বাংলাদেশী পেলেই রাস্তা থেকে ধরে বিমানবন্দরের গরাদ থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে ডাইরেক্ট তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। একেবারেই নিঃস্ব হাতে তারা বাংলাদেশে ফেরত আসছে।
এক্ষেত্রে সরকারি কোনো উদ্যোগই যে কেন কাজ করছে না, সেটি সুদর্শনা, ভ্রমণবিলাসী, অটোগ্রাফ শিকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্বেগের কারণ ঘটাচ্ছে না। তিনি তার ভ্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। যেখানে সচিব বা অতিরিক্ত সচিব গেলেই যথেষ্ট, সেখানে খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিকিৎসায় ডিগ্রীধারী দিপু মনি হাজির হচ্ছেন। অনেক দেশে সাংবাদিকরা বিস্মিত হয়েছেন যে, এই সম্মেলনে সচিব পর্যায়ের কেউ এলেই যথেষ্ট হতো, তারপরেও কেন দিপু মনি? কিন্তু কি তার এই কুড়ি কুড়ি সফরের ফলাফল, সেটা কেউ জানতে পারছে না।
বর্তমান সরকারের গত সাড়ে তিন বছরের শাসনকাল বাংলাদেশের দুঃশাসন আর কলঙ্কের ইতিহাস। ধারণা করি, এই কলঙ্কের কারণে চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন আমাদের ‘বার বার দরকার' প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পৃথিবীর বহু কুখ্যাত শাসকের নাম এখনও মানুষ স্মরণ করে। আধুনিককালে এড্লফ হিটলার, হাইলেসেলাসি, ইদি আমিন, হোসনি মুবারক এরা কুখ্যাত শাসক হিসাবে স্মরণীয়। এসব দেশে বাংলাদেশের ক'জনই বা গেছে? কিন্তু সবাই জানেন, হিটলার অপশাসক ছিলেন। কিংবা অন্যরাও। ফলে তাদেরকেও মানুষ মনে রাখে। এবং আমার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বলতে পারি যে, শেখ হাসিনা সরকারও অপশাসক হিসেবে এদের পাশে ঠাঁই করে নেবেন।
২০০১ সালের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেন শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। সে নির্বাচন অবশ্য সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতির অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শেখ হাসিনার সে কি রাগ! সেই রাগ থেকে ঐ পরাজয়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতেই কিছুদিনের মধ্যেই বলতে শুরু করলেন যে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকার ‘চোর, চোর, মহাচোর'। ভাল। শেখ হাসিনার অাঁচল বিছিয়ে ডেকে আনা মইন-ফকরের অসাংবিধানিক সামরিক সরকার তার টিউনে নাচতে শুরু করে দিলো। এই ইতরেরা শেখ হাসিনার কথা অনুসরণ করে বলতে থাকলো যে, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ বিএনপির সকল লোক, ‘চোর, চোর, মহাচোর'।
লোক দেখানোর জন্য ঐ নষ্ট লোকেরা এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করলো যে, শেখ হাসিনা সরকারও দুর্নীতিবাজ। তারপর বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমানকে গ্রেফতার করে। তার ওপর মইন-মাসুদ যে পৈশাচিক ও লোমহর্ষক নির্যাতন করলো, তাতে তার মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। তিনি লন্ডনে চিকিৎসাধীন। জেনারেল মাসুদউদ্দিনকে শেখ হাসিনা একেবারে কোলে নিয়ে আছেন। এই সাড়ে তিনবছরে কেবলই তার চাকরির মেয়াদ বেড়েই যাচ্ছে। অথচ শেখ হাসিনা যে মাত্রায় প্রতিহিংসাপরায়ণ তাতে ধারণা করা স্বাভাবিক ছিল যে, মইন-মাসুদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। স্বঘোষিত জেনারেল মইনকে সাধারণ মানুষ দেখা হলেই লাথি মারতে পারে এই ভয়ে তিনি নাগরিক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। এবং আশ্চর্য এই যে, মইনউদ্দিন এবং ফখরুদ্দিন দুজনেই কোনো এক সময়ে মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। এরা বাংলাদেশের কেউ নন।
সেটাও শেখ হাসিনা খুব ভালভাবে জানেন। তারপরেও তিনি এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তো নেনইনি, বরং এদের রক্ষার জন্য সর্বাত্মক আয়োজন সম্পন্ন করেছেন। তিনি অনেক হম্বিতম্বি করছেন যে, ভবিষ্যতে আর যাতে কোনো অসাংবিধানিক সরকার আসতে না পারে, সে জন্য তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন। তার অর্থ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। অর্থাৎ জেনারেল মইনের মতো কোনো ইতর যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের একটি তাকে একেবারে অাঁচল বিছিয়ে ডেকে আনে, তখন তিনি সন্তুষ্ট। তারা যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংক, আইডিবি, ইউএনডিপি, আইএমএফ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন প্রভৃতির সমর্থনে ক্ষমতা লাভ করে ফেলেন। মইনউদ্দিন, ফখরুদ্দিন তো অসাংবিধানিক সরকার ছিল, তখন তিনি টু শব্দটিও করেননি। কেন?
এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। কিন্তু আল্লাহতায়ালার বিচার বলে একটি কথা আছে। বিশ্বাসঘাতক, বেঈমান মইনউদ্দিন এখন যুক্তরাষ্ট্রে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। তার মেরুদন্ডের রজ্জু নষ্ট হয়ে গেছে। একটি পত্রিকায় ছবি দেখলাম, গলায় সার্ভিক্যাল স্বার্ফ, পেছনে পট্টিবাঁধা, হুইল চেয়ারে এক লুলা। তিনি জেনারেল মইন। বাংলাদেশের সবচাইতে বড় মীরজাফর, বিশ্বাসঘাতক, ইতর এবং নষ্ট প্রাণী। যখন প্রচ্ছন্নভাবে ক্ষমতায় ছিলেন তখন আফগানিস্তানে তিনমাসের জন্য ক্ষমতায় আহরণকারী দস্যু সর্দার বাচ্চায়ে সকাবের মতো যা খুশি তা করেছে। এই মীরজাফর ভারতে গিয়ে সাত ঘোড়া নিয়ে এসেছে। ট্রয়ের যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ ছিল ঘোড়া। তিনি ভারত সফরে গিয়েছিলেন, যদিও সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন মাত্র, কিন্তু ভারত তাকে রাষ্ট্র/ সরকার প্রধানের মর্যাদায় লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়েছে। এবং বলেছে যে, গত সাঁইত্রিশ বছরে বাংলাদেশে জেনারেল মইনের মতো এমন ভারতীয় মিত্র আর কেউ ক্ষমতাসীন হয়নি।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই যে, জনরোষে এবং সরকার পরিচালনায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যখন তাকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হলো, তখন পূর্বের ষড়যন্ত্রকারীরাই নির্ধারণ করেন যে, মইনের মতো ভারতীয় সেবাদাস কাউকে ক্ষমতায় আসীন করতে হবে। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা আওয়ামী লীগকেই বেছে নিয়েছে। বিএনপির সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য হেন কোনো অপবাদ নেই, যা তারা দেয়নি। বিএনপি দুর্নীতিবাজ, বিএনপি জঙ্গিবাদী, বিএনপি-জামায়াত জোট দেশে ইসলামী মৌলবাদীদের মদদ দিচ্ছে, এমন আরও কত কি। কিন্তু জেনারেল মইনের স্বৈরাচার দুবছর ধরে তদন্ত করেছে। তারা আদালতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে সাক্ষ্য-প্রমাণ যোগাড় করে প্রকাশ করেছিল যে, তিনিই প্রকৃতপক্ষে মহাদুর্নীতিবাজ। কিন্তু ভারত-মার্কিন চাপে মার্কিন চক্র তাকে রক্ষা করতে চায়। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কত অভিযোগ যে আনা হয়েছিল, কত অপপ্রচার যে করা হয়েছিল, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। কিন্তু মইনের সরকার দুইবছর ধরে হাজার তদন্ত করেও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কোনো তথ্যপ্রমাণই হাজির করতে পারেনি। বর্তমান সরকার তার সাড়ে তিনবছর ধরে একই কান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে একটি প্রমাণও হাজির করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা দায়ের করেই যাচ্ছে। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই যে, শেখ হাসিনা তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো মোকাবিলা না করে বরং সে মামলাগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করে নিয়েছে। শুধু তিনিই নন, তার দলের অন্যান্য নেতানেত্রী ও আন্ডাবাচ্চাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হাজার হাজার মামলা তিনি প্রত্যাহার করেছেন।
এখন সরকার একেবারে উলুধ্বনি দিয়ে দুর্নীতিতে নেমে পড়েছে। কিন্তু জোট সরকারের বিরুদ্ধে তাদের চাপা বন্ধ হয়নি। দেশের এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে আওয়ামী নেতাকর্মীরা দুর্নীতি-লুটপাট করছে না। হয়তো তা চাপা দিয়েই রাখা যেত। কিন্তু বাধ সাধল বিশ্বব্যাংক। তারা প্রমাণ পেল যে, শেখ হাসিনার প্রিয়ভাজন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের কোম্পানি ও দুই সচিব সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ায় বিশাল দুর্নীতিতে জড়িত। তারা সরকারকে বলল, এই তিনজনকে না সরালে পদ্মাসেতুতে বিশ্বব্যাংক কোনো ঋণ দিবে না। এবং সঙ্গে সঙ্গে এডিবি, জাইকা, আইডিবি একযোগে সরকারকে জানিয়ে দিল যে, এই দুর্নীতির সুরাহা না হলে তারাও বাংলাদেশকে কোনো ঋণ দেবে না। সরকার তাদের সে কথা মেনে নেয়নি। শুধুমাত্র শেষ পর্যন্ত যা করল, তা হল, আবুল হোসেনকে যোগাযোগ থেকে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে বদলি করে দিল। আর শেখ হাসিনা বড় গলায় বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে বসল যে, বিশ্বব্যাংককে প্রমাণ করতে হবে আবুল হোসেন দুর্নীতি করেছে। বিশ্বব্যাংক তথ্যপ্রমাণও সরকারের কাছে হাজির করল। সরকার সেটা আমলে নেয়নি। শেষ পর্যন্ত পদ্মাসেতুতে ঋণ দেয়ার যে চুক্তি বিশ্বব্যাংক করেছিল, সে চুক্তি তারা বাতিল করে দিল। এবং বিশ্বব্যাংকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক যে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে প্রতিশ্রুতিও তারা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। জাইকা এবং আইডিবিও সম্ভবতও একই পথ অনুসরণ করবে।
আর এই ঘটনা নিয়ে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে ঢিঁঢিঁ পড়ে গেছে। এক আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই যে, দুর্নীতির দায়ে যেদিন বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিল করেছে, সেদিনই শেখ হাসিনা বলেছেন যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই কেবল উন্নয়ন হয়। আর বিএনপি ক্ষমতায় গেলে শুধুই দুর্নীতি হয়। চোরের মার বড় গলা আর কাকে বলে। কিন্তু ক্ষমতার মদমত্ততায় শেখ হাসিনার অন্ধ সরকার কিছুতেই উপলব্ধি করতে পারছে না যে, যারা তাদের আদর করে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, তারা সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আর ভারত তার স্বার্থে যে কোনো সময় অবস্থান বদলে সিদ্ধ হস্ত। মইনের অভিজ্ঞতা থেকে শেখ হাসিনা তা বুঝলে হয়তো ভালই করতো।

শনিবার, ৩০ জুন, ২০১২

এ আমরা কেমন সমাজ নির্মাণ করে চলেছি?

এ আমরা কেমন সমাজ নির্মাণ করে চলেছি?



॥ ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ॥

এখন আমরা যে যার যেমন খুশি, তাই বলছি। যে যার যেমন খুশি, তাই করছি। এই যেমন খুশির কাতার থেকে ব্যক্তি, আইন, প্রশাসন, বিচার কেউই বাদ পড়ছে না। বিগত ৪১ বছরে বাংলাদেশ সম্ভবত এত বিপন্ন কখনো হয়নি। এ রাষ্ট্রে অর্থনীতি গেছে, কূটনীতি গেছে, মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার গেছে, যে কেউ যখন যাকে খুশি গুম-খুন-ধর্ষণ-নির্যাতন করতে পারছে। বিচার হলো এই যে, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামিরা সরকারের প্রকাশ্য মায় বুক ফুলিয়ে জেল থেকে বের হয়ে আসছে। মন্ত্রীরা সার্কিট হাউজে ডেকে তাদের ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনা জানাচ্ছেন। মাদক নিয়ে এখন আর রাষ্ট্রের কেউ চিন্তিত নয়। প্রশাসনের কেউ চিন্তিত নয়। মাঝেমধ্যে দেখা যায়, হাজার হাজার বোতল আটককৃত ফেনসিডিল পুলিশ বুলডোজার দিয়ে ডলে ভেঙে দিচ্ছে। কিন্তু তা এ দেশে আসার পথ রুদ্ধ করার কোনো পদপে কেউ নিচ্ছে না। অস্ত্র আসছে। মাদক আসছে। আমদানিকৃত পণ্যের বদলে দুই নম্বরি বিলাসসামগ্রী আসছে। সরকার কেবলই চুপচাপ দেখে যাচ্ছে। কিংবা একে উৎসাহিত করছে।
বুদ্ধিজীবী তথা সুশীল সমাজের কেউ কেউ পত্রপত্রিকায় লিখে কেবল প্যানডোরার বাক্সের শেষ দুর্বল মৌমাছিটির মতো আশার আলো জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আজ আশা নেই, ভালোবাসা নেই। কেউ কেউ স্যাটেলাইট টেলিভিশনে গিয়ে দু’চার কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। তাদের সবাই এখন প্রায় চ্যানেলে নিষিদ্ধ হতে বসেছেন। সরকার অমুক লোকদের আনতে হবে বলে যে আদেশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, তার বাইরে মুক্ত চিন্তার বুদ্ধিজীবীদের টিভিতে আগমন বিরল ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এখন স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল সংবাদপত্রের মতোই শক্তিশালী। কারণ গ্রামগঞ্জেও ডিস লাইন আছে। এবং নিরর সাধারণ মানুষও গভীর রাত পর্যন্ত ডিস লাইনের পাশে বসে থাকে। সেটিও বড় বেশি নিয়ন্ত্রিত।
সরকার আইন করেছে, কোন দেশের সাথে, কার সাথে তারা কী চুক্তি করবে, এটি প্রধানমন্ত্রী ছাড়া এ দেশের নাগরিকদের জানার অধিকার নেই। সে অধিকার আইন করে রহিত করা হয়েছে। যে সংসদ সদস্যরা হ্যাঁ বলে রায় দিয়েছেন, তারা কি ভেবে দেখেছিলেন যে, এর মাধ্যমে তার দেশ তার নির্বাচনী এলাকায় তার সার্বভৌমত্ব মারাত্মকভাবে ুণœ হতে পারে। সম্ভবত সেটি বিবেচনা করার কথা তারা চিন্তাও করেননি। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে তারা কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন। সংসদে একটা ইস্যুতেই কেবল তারা মুখ তুলতে সাহস করেছেন যে, বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ দিতে হবে। এর বাইরে রাষ্ট্র যে যায়, এমন সব আইন তারা শুধু ‘হ্যাঁ’ বলে পাস করে দিয়েছেন। সংসদ সদস্যরা এরকম ‘হ্যাঁ’ বলায় ভারত তিতাস নদীর ওপর দিয়ে একেবারে নদী বন্ধ করে পাকা রাস্তা নির্মাণ করেছিল, তাদের শত শত টন ওজনের ট্রেইলার পার করার জন্য। সেটা প্রায় মাস ছয়েক চালু ছিল। নদী হত্যা করা হচ্ছে। মানুষের জীবন-জীবিকা, পানির প্রবাহ সব বন্ধ হয়ে গেছে। যে নৌকা সরাসরি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেত পণ্য নিয়ে, তারা আর যেতে পারেনি। সরকার আশ্চর্য কথা বলল। বলল, তারা জানে না কারা এই নদীর ওপর বাঁধ দিয়েছে। মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ, আপনারা কি জানেন কারা বাঁধ দিয়েছিল? গোটা এলাকার লাখ লাখ মানুষ জীবন-জীবিকায় বিপন্ন হয়ে পড়েছিল? সম্ভবত মহাজোটের কোনো সংসদ সদস্যই এর জবাব দিতে পারবেন না। দিতে পারলে অনেক আগেই তারা মুখ খুলতেন। 
তার অর্থ হলো, যেকোনো কারণেই হোক সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টার ও সংসদ সদস্যরা বোধ করি ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছেন। তাদের কিছুই করার নেই। বলার নেই। ১৯৭২-৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালে দ্রুত পণ্য চাহিদা মেটাতে ওজিএল বলে এক লাইসেন্স প্রথা চালু করা হয়েছিল। তার নাম ওপেন জেনারেল লাইসেন্স। এখন বাংলাদেশে সবকিছু ওপেন জেনারেল লাইসেন্স, যার যা খুশি, তাই বলে যেতে পারছেন। এর জন্য কোনো জবাবদিহিতা নেই কিংবা জবাবদিহিতার প্রয়োজনও নেই। সবকিছু ওপেন জেনারেল লাইসেন্স। খুন করতে চাও করো। নিজে করলেও তি নেই। না হলে হাজার পঞ্চাশেক টাকা জোগাড় করে একজন ভাড়াটে খুনির ব্যবস্থা করো। যে কাউকে খুন করো। কোনো অসুবিধা নেই।
সরকারও বলতে গেলে সে ভূমিকায়ই অবতীর্ণ হয়েছে। সব মহল থেকে অভিযোগ উঠছে, র‌্যাব-পুলিশ পরিচয়ে কাউকে কাউকে তুলে নেয়া হচ্ছে। তারপর তাদের আর হদিস মিলছে না। এটা শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। স্কুলছাত্র, কলেজছাত্র, রাজনৈতিক নেতাÑ সবাই নির্বিঘেœ গুম হয়ে যাচ্ছে। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আদালত নির্দেশ দিচ্ছেন তাদের সন্ধান দাও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সন্ধান তো করতে পারছি না, কী করব? এ রকমই চলছে সবকিছু। প্রতি েেত্রই সন্দেহ হচ্ছে, এসব গুম, খুন, সন্ত্রাসের সাথে সরকার জড়িত। তারা যে পারছে না, তা নিয়ে সরকারে যেহেতু কোনো মাথাব্যথা নেই, ফলে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, সরকার সত্যি সত্যি জড়িত। 
আমরা সাধারণ নাগরিকেরা প্রতি পদে পদে ভয়ের সাথে চলি। ভীত হয়ে থাকি। এই যে বাসায় রওনা হলাম, বাসে কিংবা গাড়িতে। ফিরতে পারব তো? বাসে যদি যাই, তাহলে মনে হয়, বাস থামিয়ে কেউ একদিন বাসের ভেতরে জিজ্ঞেস করবে যে, এই বাসে রেজোয়ান সিদ্দিকী বলে কোনো যাত্রী আছে কি? খুব স্বাভাবিক যে, সৎ মানুষ হিসেবে আমি সাড়া দেবো। তারপর হারিয়ে যাবো। কেউ আর কোনো দিন আমার সন্ধান পাবে না। গাড়িতে যদি যাই, ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনার পর ড্রাইভারকে বলে রেখেছি, কেউ যদি পেছন থেকে গাড়িতে আঘাত করে তাহলে ট্রাফিক সিগন্যাল-টিগন্যাল ভঙ্গ করে যেভাবে পারো দ্রুত সে এলাকা ত্যাগ করে যেখানে মানুষ বেশি সেখানে থামাবে। ড্রাইভার বলল, স্যার, থানার কাছে গিয়ে থামাব? আমি বললাম, কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ থানা এখন আর কোনো ভরসার স্থল নয়। জনগণই ভরসাস্থল। মহান আল্লাহ তায়ালার অপরিসীম রহমতে এখন পর্যন্ত বাসে বা গাড়িতে তেমন বিপদে পড়িনি। 
কিন্তু আমি বিপদে পড়িনি, এ দেশে শত শত মানুষ এভাবে বিপদে পড়ে গুম হয়ে গেছে। তাদের পরিবারের আর্তকান্না সরকারের হৃদয় স্পর্শ করেনি। এখন সম্ভবত দেশে কোনো সরকার নেই। ঘাতক আছে। লুটেরা আছে। সরকারের মদদে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটের বন্দোবস্ত আছে। এবং সংসদে মাননীয় সদস্যরা ‘হ্যাঁ’ বলে এমন এক বিধান পাস করেছেন যে, বিদ্যুৎ বিষয়ে কোনো যুক্তি বা কোনো বিষয়ে কোনো আদালতে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ আপনারা এমন আইন পাস করেছেন বটে, কিন্তু আপনারা সম্ভবত এই ধারণা করেন যে, শেখ হাসিনা যাই করুন না কেন আপনার রাজনৈতিক পরিণতি এবং এলাকার জনগণের সাথে আপনাদের থাকতে হবে এবং এ দেশেই থাকতে হবে। এমনকি শেখ হাসিনা যদি নাও থাকেন, তাহলে আপনাদের জনগণের সাথে থাকতেই হবে। বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কেউ নেই। তার ছেলে মার্কিন নাগরিক। মেয়ে কানাডিয়ান। বোন ব্রিটিশ। তাদের নাতিনাতকুরেরা বিদেশিনীদেরই বিয়ে করছেন। ফলে শেখ হাসিনার এ দেশে কী আছে? কার্যত টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবের মাজার। আর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়ি। এ ছাড়া বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আর কিছুই নেই। এবং তিনি সুযোগ পেলেই যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। হয়তো সেখানেই অভিবাসী হবেন। 
কিন্তু তার শাসনকাল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মসীলিপ্ত এক অধ্যায়। চতুর্দিকে শুধুই ধ্বংসযজ্ঞ। শুধুই সর্বনাশের খেলা। সবচেয়ে বড় তি রাষ্ট্রের তিনি যা করেছেন তা হলোÑ এই সমাজ সংস্কৃতির কাঠামো তিনি যেন একেবারে ভেঙে দিয়েছেন। হাজার হাজার বছর ধরে এখানে যে সমাজ কাঠামো গড়ে উঠেছিল, যে মূল্যবোধ গড়ে উঠেছিল, এখানকার আবহাওয়া, প্রকৃতি, পরিবেশ, এ দেশের মানুষের জীবনাচরণ নির্দিষ্ট করেছিল। তার ফলে প্রায় দুই হাজার বছরের অবিরাম প্রচেষ্টায় যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল তাকে তিনি একেবারে তছনছ করে ফেলেছেন। এ যে কী বিশাল সুদূরপ্রসারী ধ্বংসকারী প্রভাব এই সমাজের ওপর পড়বে, সেটা বোঝার মতা সম্ভবত তারও নেই এবং তার পরামর্শকদেরও কারো নেই। আর যদি থাকেও, তাহলে ইচ্ছাকৃতভাবে এ দেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে তিনি উঠেপড়ে লেগেছেন। যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য একটি জাতিসত্তা গঠন করে এবং সে জাতিসত্তায় স্বাধীনতার আগ্রহ প্রবল করে। তারই জের ধরে এ দেশে যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে এই ভূখণ্ডের মানুষ নিজেদের বসবাসের জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেছে। গোটা দণি এশিয়ায় কোনো দেশই যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। সবাই স্বাধীনতা অর্জন করেছে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। ঔপনিবেশিক শাসকদের সাথে আলোচনা করেই কখনো কখনো ঔপনিবেশিক শাসকেরা তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই এসব দেশ ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন। সে েেত্র দণি এশিয়ায় বাংলাদেশ ও তার মানুষ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। 
এই যুদ্ধকে গৌরবান্বিত করার জন্য জিয়াউর রহমান প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। দেশ ও দেশের মানুষকে তিনি গৌরবময় মর্যাদা দেয়ার জন্য একদিকে রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন মাইলফলক নির্মাণ করেছিলেন, তেমনি এ দেশের জনগণের মুক্তির জন্য তার নীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। সেখানেই জিয়া অনন্যসাধারণ। তার নীতি যদি এ দেশে পরবর্তী শাসনকালে সঠিকভাবে অনুসৃত হতো, তাহলে বাংলাদেশ এখন ধারণা করি মালয়েশিয়ার চেয়েও অনেক ওপরে থাকত। 
শেখ হাসিনার সরকার সে পথ পরিহার করেছেন। সেই সাথে এ দেশের ইতিহাস থেকে জিয়াউর রহমানের নাম একেবারে বোধ করি মুছে দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শেখ হাসিনাকে কে বোঝাবে যে, এভাবে কারো কৃতি বা কীর্তি কিছুই মুছে ফেলা যায় না। ইতিহাস আপন গতিধারায় চলতে থাকে।
যে ইসলাম এই রাষ্ট্রের ভিত্তি, সেই ইসলামকে একেবারে মুছে ফেলার জন্য শেখ হাসিনার প্রচেষ্টার অন্ত নেই। সংবিধানে বিসমিল্লাহ এখনো অব্যাহত আছে বটে, কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালার নামে যা কিছু করার বিধান সংবিধানে ছিল, তার সবই ইতোমধ্যেই মুছে ফেলা হয়েছে। প্রশাসনের সর্বত্রই বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের প্রবল প্রতাপ, যারা মুসলমান নয়। নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে শেখ হাসিনার সরকারের বিবেচনায় এখন মুসলমান তার যোগ্যতা সম্পূর্ণই হারিয়েছে। প্রশাসনের চেহারা দেখলে মনে হয়, মুসলমানদের ফের এ দেশে অচ্ছুৎ করে তোলা হয়েছে। মুসলমানের দেশে মুসলমানরাই এখন যেন নিজ ভূমে পরবাসীতে পরিণত হচ্ছে। শিাব্যবস্থা থেকে ধর্মের নিশানা উধাও করা হয়েছে। এমনকি মাদ্রাসা শিাব্যবস্থায়ও আলেম তৈরির পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। দেশে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে দেশ সম্পূর্ণরূপে ভারতনির্ভর হয়ে পড়ে। একদিকে ধর্মের অস্তিত্ব বিলোপ, সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব বিলোপ, অন্যদিকে ভারতের সীমাহীন আগ্রাসন। দেশকে, দেশের ভবিষ্যতকে সীমাহীন অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। 
নতুন প্রজন্ম যেমন শিাদীায় পিছিয়ে পড়ছে, জ্ঞান-গবেষণায় পিছিয়ে পড়ছে, তেমনি তাদেরকে ধর্মীয় বোধগুলো থেকে কেবলই বিচ্ছিন্ন করে তোলা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রচেষ্টার বিপরীত চিত্রও সমাজে একেবারে অনুপস্থিত নয়। চোখ-কান খোলা রাখলে শেখ হাসিনা নিজেও তা দেখতে পেতেন, এটুকুই আশার কথা। 
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

বুধবার, ২৭ জুন, ২০১২

হ্যালো, নষ্ট সুশীলেরা



ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী :
 জোট সরকারের শেষ দিকে বাংলাদেশে সুশীল সমাজ নামক এক সংঘবদ্ধ ইতরগোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছিল। যে ইতরেরা এই সমাজে নিজেদের ‘সুশীল সমাজ' ঘোষণা করে সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির দালাল হিসাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল। তারা যে কী মাত্রায় নষ্ট ও ইতর ছিল সেটা ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর। আমি কেঁদে-কেটে এক নিবন্ধ লিখে তাদের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম, ‘আম্মু, আমি সুশীল হবো'। জীবনে এই প্রথম সে লেখায় সুশীল হওয়ার জন্য আমি আমার যোগ্যতার বিস্তারিত তুলে ধরেছিলাম। ওনাদের জানিয়েছিলাম, ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে নয়, পত্রিকায় লিখে। কারণ ওনারা তখন সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদীদের মদদে এতটাই শক্তিশালী ছিলেন যে, আমার মতো নিম্নমানের মানুষের সে আকুল আবেদন শুনে তাদের কেউ আমাকে ঐ সুশীল সমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে ডাক দেননি। তার জন্য কোনো আবেদন পত্রের ব্যবস্থা ছিল কিনা, সেটিও আমার জানা নেই। থাকলেও অমন খোলা আবেদনের পর তারা নিশ্চয়ই আমাকে আবেদন ফরমটি অন্তত মেইলে পাঠিয়ে দিতেন।
বলা নেই, কওয়া নেই, দশ-বারোজন লোক মিলে হঠাৎ এক কলঙ্কিত বিকেলে নিজেদের সুশীল বলে ঘোষণা করে বসেছিলেন। তখন সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদীরা সুশীল খুঁজছে। এবং তারা জানে সঠিক সুশীল কে হতে পারে। ফলে তারা টাকা ঢালল, সুশীলেরা জোট সরকারকে তথা রাজনৈতিক সরকারকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য হেন কোনো অপকর্ম নেই যাতে লিপ্ত হলেন না। তাদের প্রধান অস্ত্র তাদের হাতে গোটা দুই প্রভাবশালী পত্রিকা ছিল, কিছু এনজিও ছিল, আর ছিল কিছু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। তাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে সারা পৃথিবীর কাছে কিভাবে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। আহা! সেকি শোরগোল। মইন-ফকরের মতো মীরজাফরদের সঙ্গী হয়ে কিভাবে দেশে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা যায়, তার জন্য ঐ ইতরেরা মরিয়া হয়ে উঠেপড়ে লাগল। রাষ্ট্র ও জনগণের বিরুদ্ধে এই দ্রোহের তারা নানান নাম দেয়ার চেষ্টা করলেন। এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রধান দুটি পত্রিকায় কী যে সব ইতর রিপোর্ট ছাপা হতে থাকল, চল্লিশ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে এরকমটি কখনও দেখি না।
সাংবাদিকতাকে তারা এমন নষ্ট ও স্বার্থবুদ্ধি পর্যায়ে নিয়ে গেল যে, আত্মগ্লানি অনুভূত হতে থাকল। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্সসহ পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেছি। হল্যান্ডের আইএসএস থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেছি। এই সুশীলদের মাত্র দুজনের পিএইচডি ডিগ্রী ছিল। তাদের একজন সত্যিকারই গবেষণা করে পিএইচডি অর্জন করেছিলেন। সমাজে তার সুখ্যাতিও ছিল। আর একজন পিএইচডি পেয়েছিলেন রাশিয়ান। তিনি রাশিয়ার এমন এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স অর্জন করেছিলেন যেখানে মস্কোপন্থী ছাত্রদের অনার্স পাস করলেই তার নাম দেয়া হত পিএইচডি। তেমন এক পিএইচডি এই সুশীল সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এখনও নামের আগে ডক্টর লেখেন। আমি দশ বছর সারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে আমার পিএইচডি'র সকল রসদ সংগ্রহ করেছি। গোটা পঞ্চাশেক বই লিখেছি। টেলিভিশনে বিভিন্ন বিষয়ে নিরপেক্ষ বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে খানিকটা অতিরিক্ত পরিচিতি লাভ করেছি। প্রতি সপ্তাহে দুই-তিনবার পত্রিকায় লিখে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা করেছি।
কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনি যে, আমি কেন সুশীল হতে পারব না। সুশীল হওয়ার জন্য আমার আকুল আবেদনে তারা কেউ সাড়া দেননি। কিছুদিন ভারী ভগ্নমনোরথ ছিলাম। আমি ভাবলাম, সুশীলদের সকলেরই তো পিএইচডি ডিগ্রী নাই। আমার তো ডিগ্রী আছে। কৃতকর্ম আছে, যা ঐ সুশীলদের একজন ছাড়া বাকি কারও ছিল না। তবু আমার আকুল আবেদন তারা গ্রাহ্য করেননি।
তারা অবিরাম বলে গেছেন যে, জোট সরকার বাংলাদেশকে এক ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। সেই জন্য তারা সভা-সেমিনার করেছেন। বিদেশী পয়সায় গ্রামে গ্রামে সৎপ্রার্থীর খোঁজ করতে গেছেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের ধাওয়া খেয়ে তারা ফিরে এসেছেন। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সুশীলদের একজন অনলাইনে সৎমানুষের রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়ে বেশ একটা আলোড়ন তুলেছিলেন। এক তছনছ কান্ড। এ ভদ্রলোক এখন অনেক বিপদে। তার সাকসেস স্টোরির শেষ নেই। কিংবা সাকসেস স্টোরির নামে তার প্রতিষ্ঠানের লুণ্ঠনের কোনো শেষ নেই।
বাংলাদেশে এক আমরা আশ্চর্য ব্যাপার দেখি। সেটি হলো, এ দেশের নাগরিকদের সম্মানিত ব্যক্তিরা নিজেদের সম্মান কেন যেন ব্যক্তিস্বার্থে ধরে রাখতে পারেন না। প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাস বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে গণতন্ত্র রক্ষায় যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিশ্বাস্য ঘটনা হয়ে থাকবে। কিন্তু নির্বাচনের আগে তিনি এক অদ্ভুত কান্ড করে বসলেন। তিনি জাতীয় সংসদের এমপি হিসাবে দাঁড়াবার জন্য বিএনপি'র কাছে আবেদন করলেন। তার আবেদন একটু লম্বা ছিল। যদি তাকে মনোনয়ন না দেয়া হয় তাহলে যেন তার ছেলেকে মনোনয়ন দেয়া হয়। এটা ভাবতেও বিস্ময় লাগে। সাবেক প্রেসিডেন্ট থাকবেন সকল রাজনীতি, সকল স্বার্থবুদ্ধির ঊর্ধ্বে। তিনি হবেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। না। জেনারেল নাসিমের সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা রোধ করে দিয়ে এ দেশের মানুষের হৃদয়ে তিনি গভীর ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে দাঁড়াতে চেয়ে বিএনপি'র কাছে আবেদন করেছিল। আমাদের ট্র্যাজেডি এটাই। স্বৈরাচারী এরশাদ কোনো বিবেচনার যোগ্যই নন। কিন্তু আবদুর রহমান বিশ্বাসের কাছে প্রার্থিত ছিল না। তেমনি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী এমন এক ইতর কাজ করে বসল যে, তাকে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান পদ ত্যাগ করতে হলো। তারপর তিনি অনেক রাগ। বিএনপি'র বিরুদ্ধে একজন রাজনৈতিক দল গঠন করে নিজেকে প্রেসিডেন্ট পদের মর্যাদা থেকে অনেক নিচে নামিয়ে দিলেন।
না। এটা শেখ মুজিবের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তার তো কোনো দরকারই ছিল না যে, তিনি একবার প্রেসিডেন্ট আবার প্রধানমন্ত্রী, আবার প্রেসিডেন্ট হবার জন্য সংবিধান সংশোধন করলেন। এটি ভাবাও যায় না। শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু তিনি কেন যেন ক্ষমতার মোহে মদমত্ত হয়ে উঠলেন। বাকশাল গঠন করে সকল রাষ্ট্রীয় শক্তি, প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে চাইলেন। কে কোথায় বিচারক, কি না কি রায় দিবে, কোনো দরকার আছে! শেখ মুজিব সব কিছুই নিজের হাতে নিতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ বাংলাদেশে যারা প্রেসিডেন্ট হিসাবে ছিলেন, তারা কেউই তাদের মর্যাদা রক্ষা করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। এটা আমাদের জন্য বড় দুর্ভাগ্যের বিষয়।
কিন্তু আলোচনা শুরু করেছিলাম সুশীল দিয়ে। এখন কি রাষ্ট্র ব্যর্থ? সেইসব সুশীল একেবারে রক্ত খেয়ে লম্বা জোঁক যেন। একেবারে আসল রূপে ফিরে গেছেন। তাদের লক্ষ্য অনুযায়ী, কিংবা প্রভুদের সেবাদাস হিসেবে তারা যা করেছে, তার চাইতে নিম্নমানের ইতরকর্ম পৃথিবীর ইতিহাসে কোথায়ও ঘটেছে কিনা, হুবহু তেমন কোনো ইতিহাস আমার জানা নেই। সুশীলরা বলতে পারেন, আমি ইতিহাস পড়িনি। তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করতে চাই যে, তারা তখন যে খবর ছাপতেন, তা কোনো বিবেচনায়ই খবর ছিল না। জোট সরকারের মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের বিরুদ্ধে তারা এমন গীবত প্রচার করতে লাগলেন, তা কোনো যৌক্তিকতার মানদন্ডে গ্রহণযোগ্য ছিল না। যেমন কোনো মন্ত্রী বা এমপি ৮ ফাইল ত্রাণের টিন চুরি করেছেন। কেউ চুরি করেছেন গাছ, কেউ বা গরু। এসব যখন প্রকাশিত হতো তখন গা গুলিয়ে আসত।
বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘকালের ও সবচেয়ে সফল অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান সম্পর্কে তারা লিখল যে, তিনি বন বিভাগের গাছের চারা চুরি করেছেন। সে চারা লাগিয়ে তিনি তার বাগানবাড়ি সজ্জিত করেছেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো এই যে, বছরের বৃক্ষরোপণ মওসুমে বন বিভাগ নানা জাতের লক্ষ লক্ষ চারা বিনামূল্যে জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করে। এবং নানা প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করে। সাইফুর রহমান যদি সে গাছ নিয়ে গিয়ে তার বাগানবাড়িতে লাগিয়ে থাকেন, তাহলে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, সে গাছগুলোর সুরক্ষা হবে। সেগুলো যথাযথভাবে বেড়ে উঠবে ও যথার্থ বিকাশ নিশ্চিত হবে। অর্থাৎ বনবিভাগের উদ্দেশ্য সফল হবে। তাকে দুর্নীতি বলে এমনভাবে প্রচার করা হলো যে সাইফুর রহমান বিরাট দুর্নীতি করে ফেলেছেন।
এমনি হাজারো গপ্পো তারা প্রতিদিন প্রচার করেছে জনগণকে ধোকা দেওয়া ও বোকা বানানোর জন্য। শেষে শুধু জোট সরকার নয়, সকল রাজনৈতিক দল ধ্বংস করার জন্য তারা উঠেপড়ে লেগেছিল। রাজনৈতিক দল মানেই যেন চোর-বাটপারের আখড়া। অর্থাৎ দেশে রাজনৈতিক দলই থাকতে পারবে না। কেবল সুশীলেরা থাকবে। তখন এই নষ্ট লোকেরা সৎ মানুষের দল গঠনের জন্য বিদেশী টাকায় গ্রামে গ্রামে ঘুরছিল। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। সাধারণ মানুষই তাড়া করে তাদের আবার রাজধানীতে ফেরত পাঠায়। যখন তারা দেখল যে, এভাবে সৎ মানুষ খুঁজতে গেলে জনগণের হাতে মার খাওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো পথ থাকবে না। তখন তারা আর এক সুশীলকে দিয়ে সৎ মানুষের রাজনীতির দোকান খুলতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। তবে ওইসব ইতর প্রচারণার মাধ্যমে তারা ঠিকই দেশে সামরিক আইন নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল।
কিন্তু এখন দেশের কী অবস্থা! দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া। আইন-শৃক্মখলা বলতে দেশে কিছু নেই। প্রতিদিন ডজন ডজন মানুষ গুম হয়ে যাচ্ছে। ব্যবস্থা নেই। বিচারবিভাগ, প্রশাসন, পুলিশ সর্বত্র দলীয়করণ। টেন্ডারবাজি দখলবাজিতে দিশেহারা মানুষ। অর্থনীতি ফোকলা হয়ে গেছে। বাংলাদেশ যেন ভারতের অধীনস্ত হয়ে পড়েছে। ট্রানজিট বন্দর করিডোর ভারতকে প্রদানের  মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এখন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে সুশীলেরা। তবে কী তাদের সকল আন্দোলনের লক্ষ এটাই ছিল। সে লক্ষ্য অর্জিত হয়ে গেছে বলেই এমন নীরবতা?

মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১২

গণতন্ত্র, তুমি কি কেবলই ছবি?



ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : সরকার সমর্থক পত্রিকাগুলোতে প্রধানমন্ত্রীর হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখি। বাংলাদেশে কী তার বিপুল সাফল্য। উনি অনর্গল বলে যাচ্ছেন। আমরা পাবলিক শুনে যাচ্ছি। ভাগ্য ভাল যখন বিদ্যুৎ থাকে না, তখন তার এইসব সাফল্যগাথা আমরা শুনতে পারি না। তা না হলে সম্ভবত মহাসম্মানিত মহামান্য প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা আরও অনেক মূল্যবান বক্তব্য শুনতে পারতাম। কিন্তু বিদ্যুৎ থাকে না বলে আমরা সেইসব অমৃতবচন থেকে এতটাই বিরত থাকি যে, সম্মানিত, মহামান্য প্রধানমন্ত্রী কি বলছেন, সেটা শুনতে পাই না। আমাদের মনোবেদনা কেউ বুঝতে পারবে না। মহামান্য প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এ বিষয়টা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। বিবি- গোলামের বাকশো বিটিভিতে মহামান্য প্রধানমন্ত্রীর আদ্যপ্রান্ত দেখা যায়। শুধু তিনি কেন, তার অমাত্যবর্গ, অনুচরবর্গ সবার কৌতুকাভিনয় আমরা অম্লানবদনে দেখি। কিন্তু সেটিও দারুণ মিস্ করি। কেননা যখন ঐ অনুষ্ঠানটি চলে, হুট করে বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্যুৎ বিভাগের বিরুদ্ধে এই স্যাবোটাজের জন্য আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
কে এখন বিটিভির নিজস্ব অনুষ্ঠান দেখে, সেরকম লোকের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। যেখানে ডিস নেই, সেখানে লোকেরা নিশ্চয় বিটিভির অনুষ্ঠান দেখেন। এখন গ্রামেগঞ্জেও ডিস লাইন আছে। ফলে হয় অন্যান্য স্যাটেলাইট টেলিভিশন তারা দেখেন, অথবা ভারতীয় হিন্দী সিরিয়াল দেখেন। স্যাটেলাইট টেলিভিশনও সরকারের কড়া নিরাপত্তাবেষ্টিত। তারপরেও ছিটেফোঁটা অনেক কিছু বেরিয়ে পড়ে। সংসদে  আইনকানুন যা প্রণয়ন করা হচ্ছে তা রহস্যময়। বিরোধীদলবিহীন সংসদে সরকারের ইচ্ছামতো যেকোনো আইনের বিল উত্থাপিত হওয়া মাত্র তা অনুমোদিত হয়ে যাচ্ছে। তর্ক নেই, বিতর্ক নেই, পূর্বাপর ভাবনা নেই। এতে তার এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে কী প্রভাব পড়বে সেটা সেই মুহূর্তে তারা ভাবেন না। তারা মনে করেন, মহামান্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মাননীয় মন্ত্রীদের দ্বারা যে প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করছেন, তা নিশ্চয়ই খুবই জনগুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, পাস হয়ে যায়।
জাতীয় সংসদের সদস্যরাই অনুমোদন করেছেন যে, সরকারের কোনো গোপন চুক্তি বিষয়ে তাদের জানার দরকার নেই। কিংবা তার নির্বাচনী এলাকার লোকদেরও জানানোর দরকার নেই। সে বিবেচনা থেকেই সরকার বিধান করেছে যে, বিদেশের সঙ্গে সম্পাদিত কোনো চুক্তি এমনকি তা যদি আক্ষরিক অর্থে রাষ্ট্র বিক্রির চুক্তি পর্যন্ত হয়, তাহলেও সেটা তাদের জানার দরকার নেই। কিংবা তার নির্বাচনী এলাকার জনগণকে জানানোরও কোনো প্রয়োজন নেই। কখনও কখনও ভাবতে অবাক লাগে এরা জনপ্রতিনিধি। জনপ্রতিনিধি কোনো কোনো লোক আবার তার নিজস্ব এলাকার ভোটারদের লক্ষ্য করে গুলী বর্ষণেও দ্বিধা করেন না। এর ফলে কেউ কেউ যখন জনগণ দ্বারা প্রতিহত হন, তখন আবার নিজের ভোটারদের বিরুদ্ধেই মামলা রজু করতে কসুর করেন না। হাজার হাজার লোক তাদের প্রতিনিধিদের ভয়ে গ্রামশূন্য করে জনান্তিকে চলে যান।
বিদ্যুতের সমস্যা প্রকট। বিদ্যুৎ ছাড়া দেশ অচল। কিন্তু রেন্টাল বিদ্যুতের নামে যখন চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যায়, তখন জনপ্রতিনিধিরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু কতদিন তাকিয়ে থাকবেন। মন্ত্রীদের বাসায় হয়তো সারা বছরে একদিনও বিদ্যুৎ যায় না। প্রধানমন্ত্রীর বাসায় তো যায়ই না। ফলে বিদ্যুতের কষ্ট কী সেটা ঐ পর্যায়ের লোকেরা কোনোভাবেই উপলব্ধি করতে পারেন না। এখন তো এটা ওপেন সিক্রেট যে, বিদ্যুৎ এক ভয়াবহ সংকট। যেসব মহাজোট এমপি এলাকায় যান, তাদের যদি এখনও জনগণের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতা থেকে থাকে, তবে তারা উপলব্ধি করেন যে, বিদ্যুৎ কী ভয়াবহ সংকটের সৃষ্টি করেছে। জনগণ প্রশ্ন করতে শুরু করেছে, বিশ-চল্লিশ হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে গেলো। বিদ্যুতের দাম বাড়লো। কিন্তু বিদ্যুৎ তো এলো না। এদের মধ্যে কেউ কেউ সংসদে সেই নিষিদ্ধ কথা উচ্চারণও করে ফেলেছেন। এবারের জাতীয় সংসদে মঈন-ফখর-এটিএম শামসুল হুদা-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রে শেখ হাসিনার মহাজোট অগণিত আসন পেয়েছে। কিন্তু কয়েকদিন আগে শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, আগামী নির্বাচনে তার দল ১৭৫ আসন পাবে। তাহলে বাকি পঞ্চাশ-পঁচাত্তর আসনে আওয়ামী লীগের যে ভরাডুবি হবে, এটা তিনিও সম্যক উপলব্ধি করেছেন। যেসব এমপি সংসদে বিদ্যুতের অবস্থা বিষয়ে কথা বলেছেন, তারা এখন শঙ্কিত আছেন। হয়তো তারা ভবিষ্যতে আর আওয়ামী লীগের নমিনেশন পাবেন না।
কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের উপায় কী? তারা জনগণের কথা বললে বড় বেশি অপ্রিয় হয়ে যান। সরকার সন্দেহের চোখে দেখে। সবাই তো আর গুলী করতে পারে না। এখন অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে, তাতে গুলী করা ছাড়া এমপিদের ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার আর কোনো উপায় নেই। লোকে ঘিরে ধরে। মারে। কিন্তু মার তারা কেন সহ্য করবে? তারা কোটি কোটি টাকা খরচ করে এমপি হয়েছেন জনগণের মার খাওয়ার জন্য? বরং তারা জনগণকে শিক্ষা দিয়ে ছাড়বেন। কেন তারা প্রতিবাদ করে? কেন জনগণের জন্য সংসদে তাদের কথা বলতে হয়? আর সে কারণেই তারা মহামান্য প্রধানমন্ত্রীর বিরাগভাজন হবেন? এটা তো হয় না। এ হতে পারে না। ফলে তারাও পিস্তল দিয়ে নিজ ভোটারদের রুখে দাঁড়াচ্ছে। খবরদার। আর এক পা এগুলে মৃত্যু নিশ্চিত। গুলী করে বুকের রক্ত ফুলকি দিয়ে তুলব। প্রধানমন্ত্রীও বলবেন, শাবাশ। এমন নেতাই আমার চাই।
এর আগেও প্রধানমন্ত্রী তার রাজনৈতিক জীবনে বারবার এভাবে লাশের জন্য তার কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। কোথায়ও যদি একটা লাশ পড়ে, তবে সেখানে যেন দশটা লাশ ফেলে দেওয়া হয়। এখন লাশ ফেলে দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। গত সোমবার বরিশালে এক যুবদল নেতার হাত কেটে নেওয়া হয়েছে। ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীরা শেখ হাসিনার কৃপায় ছাড়া পেয়ে মন্ত্রীদের দ্বারা ফুলের মালায় সংবর্ধিত হয়েছে। এখনও প্রতিদিন খুনকে জায়েয করা হচ্ছে। এখন বাংলাদেশে চলছে নরহত্যার উৎসব। অভিযোগ উঠেছে যে, র‌্যাব-পুলিশ সন্ত্রাসের বাণিজ্য করছে। অর্থাৎ, অকারণে কাউকে গ্রেফতার করা, তারপর সেই পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা, অর্থ না পেলে তাকে খুন করা- এইসব অভিযোগে তারা আক্রান্ত।
এখন পুলিশের আশ্রয় প্রার্থনায়ও ভয় ভয় লাগে। আশ্রয় নিতে গিয়ে কোন বিপদে না পড়ি। হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে পুলিশ এক তরুণীকে শত শত মানুষের সামনে ছিনিয়ে থানায় নিয়ে যায়। একটি মোটরসাইকেলে করে তার বাবা, মাও সে আদালতে এসেছিল বিচার প্রার্থনায়। কিন্তু আদালতে ঢোকার আগেই পুলিশ তার জীবনের সর্বনাশ ডেকে আনল। একথা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে, সাংবাদিক-উকিলদের শত বাধার মুখেও পুলিশ আদালত প্রাঙ্গণ থেকে থানা-হাজতে নিয়ে গিয়ে শারীরিক নির্যাতন করবে। তরুণী ও তার মাকে পুলিশ থানায় নিয়ে গিয়েছিল। তরুণীর মা বলেছেন, ওরা আমাকে কি নির্যাতন করেছে, তা আমি বলতে পারব না। তরুণী বলেছেন, গোঁফওয়ালা এক পুলিশ তার শরীরে স্পর্শকাতর অঙ্গে হাত দিয়েছে। তার ঘাড়ে-গালে চুমু খেয়েছে। যাচ্ছে তাই ব্যবহার করেছে।
আমরা সাধারণ নাগরিকেরা তাহলে কোথায় যাবো? যদি বিপদাপন্ন হই, শৈশব থেকে জেনে এসেছি যে, পুলিশের সহায়তা নিবে। আমি আমার সন্তানদের শিক্ষা দিয়েছি যে, পথেঘাটে কোনো বিপদে পড়লে পুলিশের কাছে চলে যাবে। এখন পুলিশ বিপদের অাঁকড়। পুলিশ মানেই বিপদ। কিন্তু পত্রিকায় মাঝেমধ্যেই প্রকাশিত হচ্ছে যে, বিভিন্ন এলাকা, গ্রাম, জনপদে জনগণ নিজেরাই প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তুলেছে। রাতভর পালা করে ডাকাত ঠেকাতে পাহারা দিচ্ছে। সেসব এলাকায় ডাকাতেরই রাজত্ব। ডাকাতেরা যদি দেখে যে, পাহারাদারের সংখ্যা তাদের চাইতে কম, তখন তারা পাহারাদারের উপরই আক্রমণ করে বসছে। এগুলো এখন বাংলাদেশে ওপেন জেনারেল লাইসেন্সে (ওজিএল) পরিণত হয়েছে। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা যা খুশি তাই করতে পারবে। পুলিশ যা খুশি তাই করতে পারবে। র‌্যাব যা খুশি তাই করতে পারবে। এতে যদি কারো মৃত্যুদন্ড হয়ও তাহলে সরকার তাদের মুক্ত করে এনে সার্কিট হাউজে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিবে। ভাবটা যেন এমন যে, জয় বাংলা, খুনিদের জয় হোক।
শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হলেন, তখন বিবিসিতে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তাতে এমন একটি ঐহিত্যবাহী দলের প্রধান হওয়ায় তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, তিনি রাজনীতি ঘৃণা করেন। তাহলে কেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হলেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে। যার রাজনীতির লক্ষ্য প্রতিশোধ, তার কাছ থেকে  সম্ভবত এর চাইতে বেশি কিছু আশা করা যায় না। শেখ হাসিনা এ বিষয়টি কিছুতেই উপলব্ধি করতে পারছেন না যে, তার পিতার হত্যাকান্ডে এদেশে একটি লোকও চোখের পানি ফেলেনি। বরং সম্ভবত তারা খুশি হয়েছিল।
সেটা এদেশের মানুষের কাল হয়েছে। কিন্তু তিনি ইতিহাস বিবেচনায় নিতে চাননি। ইতিহাস বিবেচনায় নিলে তিনি শুধুমাত্র পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রাজনীতি করছেন, এমন কথা কস্মিনকালেও বলতে পারতেন না।
দলীয় বিবেচনা এখনও এতটাই প্রাধান্য পাচ্ছে যে, দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতিরা লঙ্কাকান্ডও ঘটিয়ে দিচ্ছেন। জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার বলেছেন, ‘কি যেনো হনু রে' ভাবটা ত্যাগ করা উচিত। সোমবার জাতীয় সংসদে এক রুলিংয়ে তিনি বলেছেন, বিচারপতি শামসুদ্দিন আহমেদ মানিক তার সম্পর্কে যে কথা বলেছেন, তা সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এসব মন্তব্য করার আগে তার বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত ছিল।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থা এখন এমনই এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। সরকার-প্রশাসন-বিচার বিভাগ- সংবাদপত্র সবকিছু আজ বিপন্ন। মনে হচ্ছে, যে গণতন্ত্রের স্বপ্নে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল তা এখন উধাও। এখন মনে হচ্ছে, গণতন্ত্র? এদেশে সে কি কেবলই সোনার হরিণ? নাকি কেবলই ছবি? এখন গণতন্ত্র কেবলই সরকার সমর্থক পত্রিকায় ও মিডিয়ায় ছবি হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে। কিন্তু আমরা সাধারণ নাগরিকরা কী বলতে পারি? দূর হ', দুশাসন।

শনিবার, ১৬ জুন, ২০১২

এখন প্রতিদিন কালো দিবস

এখন প্রতিদিন কালো দিবস



॥ ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ॥

১৯৭৫ সালের ১৬ জুন বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজের জন্য এক ভয়াবহ দুর্যোগের দিন হিসেবে হাজির হয়েছিল। ওই দিন শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সর্বময় মতার অধিকারী হিসেবে সংবাদপত্রের ডিকারেশন বাতিল অধ্যাদেশ জারি করে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছিলেন। ১৯৭২-৭৫ সালের প্রায় সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশের ইতিহাস এক ভয়াবহ স্বৈরাচার আর দুঃশাসনের সময়। রীবাহিনী গঠন, মধ্যরাতের সাদা জিপ, তাদের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, খুন, গুম শেখ মুজিবুর রহমানের এই শাসনকালে বাংলাদেশের জনপদকে এক আতঙ্কের জনপদে পরিণত করেছিল। 
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের এক প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ দলের যে বিপুল বিজয়, সেটা তার ব্যক্তিগত ক্যারিশমা আর ইমেজ থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল। এ কথাও সত্য, ওই নির্বাচনের পর থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে যা হতে বলতেন, নিশ্চিতভাবে তাই হতো। আমরা যারা মওলানা ভাসানীর ধর্মভিত্তিক বাম রাজনীতির সাথে ছাত্রজীবনে বেড়ে উঠছিলাম, তাদেরও বলতে দ্বিধা নেই, শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণাকে জাতির ঘোষণা বলে মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু ১৯৭১ সালে মতা হস্তান্তরের আলোচনা যখন চলছিল, তখনো আমরা আশাবাদী ছিলাম, শেখ মুজিবুর রহমানই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছেন। এমনকি জেনারেল ইয়াহিয়া খান পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার জেনারেলদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাদ সেধেছিলেন পশ্চিম 
পাকিস্তানের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি কিছুতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। এ দিকে আবার শেখ মুজিবুর রহমানও সর্বপাকিস্তানীয় রাজনীতিবিদ হিসেবে কিছুতেই পরিচিত ছিলেন না। জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপিপিও না। ফলে তিনি একজন প্রাদেশিক নেতার মর্যাদাই কেবল লাভ করেছিলেন। সর্বপাকিস্তানীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেননি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সম্ভবত দুয়েকজন প্রার্থী দিয়েছিল। পিপিপির েেত্রও বোধ করি এ কথা সত্য। পশ্চিম পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমান পরিচিত নাম ছিলেন না। পূর্ব পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর কোনো সমর্থক ছিল না। জেনারেল ইয়াহিয়া খান অত্যন্ত সরল বিশ্বাসে জনসংখ্যার ভিত্তিতে জাতীয় সংসদের আসন নির্ধারণ করেছিলেন। তাতে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য আসন সংখ্যা কম হয়েছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কিংবা খাজা নাজিমুদ্দিন অথবা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পাকিস্তানের উভয় অংশে যতটা গ্রহণযোগ্য ছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান বা জুলফিকার আলী ভুট্টো তার কিয়দংশও ছিলেন না। বিপত্তিটা সম্ভবত সেখানেই বেধেছিল। 
শেখ মুজিবুর রহমান সম্ভবত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। এর বিভক্তি তিনি চাননি। তার বহু প্রমাণ সাম্প্রতিক কথামালায় লিপিবদ্ধ আছে। পাকিস্তানে বন্দিদশায় শেখ মুজিবুর রহমান জানতেনও না যে, কী অবিস্মরণীয় ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে এ দেশের নেতৃবৃন্দ ভালবেসে রামের খড়মের মতো সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে রেখেছিল। সে কারণেই তিনি লন্ডনে বিবিসির সিরাজুর রহমানকে বলেছিলেন, সেখানকার লোকেরা তাকে এক্সসেলেন্সি বলছে কেন? সিরাজুর রহমানই তাকে প্রথম খবর দেন যে, বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এবং তিনি সেই স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি। 
পাকিস্তানের এই দ্বিখণ্ডিত হওয়া তিনি পছন্দ করেছিলেন কি না বলতে পারি না। কিন্তু তিনি বাংলাদেশে ঢুকেই এ দেশের রাষ্ট্রপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। তার পরের কাহিনী শেখ মুজিবুর রহমানের ভারসাম্যহীন শাসনের কাল। শেখ মুজিবুর রহমান অল্প কিছু দিন প্রেসিডেন্ট থেকে মতার অভীপ্সায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বময় মতা গ্রহণ করেন। তার অপশাসন, দুঃশাসন, দলীয়করণ, তার দলের লোকদের সীমাহীন দুর্নীতি দেশকে প্রায় ঝাঁজরা করে ফেলে। কেন শেখ মুজিবুর রহমান সানন্দে এই সব অপকর্ম সম্পাদন হতে দেন, তাও বিবেচ্য বিষয়। একপর্যায়ে তিনি তার দলীয় লোকদের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতে শুরু করেন। তার অপশাসনের জন্য যারা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরোধিতা করতে শুরু করল, আকস্মিকভাবেই তিনি তাদের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়ে দিলেন। তারপর কেন জানি না, সেনাবাহিনীর বিকল্প হিসেবে তিনি রীবাহিনী গঠন করলেন। 
বাংলাদেশের ইতিহাসে রীবাহিনীর নির্যাতন আর বর্তমান সরকারের আমলে র‌্যাবের কার্যকলাপ প্রায় একই পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। রীবাহিনী ছেলেকে হত্যা করে বৃদ্ধ বাপকে তার মাথা কেটে দিতে বাধ্য করেছে। তারপর তারা সেই কর্তিত মুুণ্ডু নিয়ে মাঠে ফুটবল খেলেছে। শাসকেরা হয়তো সয়। কিন্তু আইনস্টাইনের ভাষ্য অনুযায়ী প্রকৃতি সরলতা পছন্দ করে এবং শূন্যতা পরিহার করে। শেখ মুজিবুর রহমানের এই তত্ত্বজ্ঞান ছিল কি না, সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু যখন তিনি আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে একদলীয় স্বৈরশাসন চালু করেন, তখনো তিনি বিরুদ্ধ সব মত স্তব্ধ করে দেয়ার প্রয়াসেই তা করেন। এগুলো ফলদায়ী হয়নি। এবং আশ্চর্য এই যে, যখন তিনি সর্বময় মতার অধিলিপ্সায় একদলীয় স্বৈরশাসন চালু করেন, তখন সংবাদপত্রে তার একটি ছবি ছাপা হয়েছিল, তিনি তার ড্রয়িংরুমে বসে লেনিন রচনাবলি পড়ছেন। এ ছবি ছাপা হওয়ার পর অনেকেই হেসেছেন। অনেকের জন্য কিছুই বলার ছিল না। শেখ মুজিব সমর্থকেরাও তার পদেেপ কেমন যেন বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। এ কেমন স্বদেশ! শেখ মুজিব দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন!
তখন গোটা দেশ এক ভয়াবহ আতঙ্কে। দেশে দুর্ভিরে সৃষ্টি হয়েছে। সরকার সমর্থক মন্ত্রী-এমপি-আমলারা ‘আঙুল ফুলে বটগাছ’ হয়েছেন। দুর্ভিে লাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান কেন যেন ভয়াবহভাবে নির্বিকার ছিলেন। এ রকম সময়ে তার ছেলের বিয়েতে লোকেরা সোনার মুকুট উপহার দিয়েছে। তিনি সহাস্য বদনে তা গ্রহণ করেছেন। এক দিকে পথে পথে লাশের সারি, ুধার্ত মানুষের আর্তচিৎকার, অন্য দিকে স্বর্ণের মুকুট। জনগণ বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। শেখ মুজিব বলে কথা। তখন সংবাদপত্রকে নির্দেশ দেয়া হলো, দুর্ভি বা অনাহারে কেউ মারা গেছে, এমন কথা কিছুতেই লেখা যাবে না। আঞ্জুমানমফিদুল ইসলাম প্রতিদিন শত শত বেওয়ারিশ লাশ দাফন করছে, সংবাদপত্রে তা প্রকাশ করা যাবে না। 
তবে সংবাদপত্রে কী প্রকাশ করা যাবে? দেশের সংবাদপত্র তখন এর চিত্র ছিটেফোঁটা প্রকাশ করতে শুরু করল। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো যে, একজন ুধার্ত মানুষ অন্য একজনের বমি থেকে ভাত তুলে খাচ্ছিলেন। একইভাবে দুর্ভিে মৃত্যু হয়েছে এই কথাটি শুধু লেখা হচ্ছিল না বটে, কিন্তু অনাহারে মৃত্যুর খবর প্রতিদিন বাড়ছিল। আঞ্জুমানমফিদুল ইসলাম প্রতিদিন কতসংখ্যক অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ দাফন করছিল, তার হিসাব প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে প্রতিদিন ছাপা হচ্ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে দুর্ভিরে শিকার ছিলাম। কিন্তু যারা শিকার ছিলেন না, তারাও আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। 
এর কিছু না কিছু সংবাদ প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছিলই। শেখ মুজিব যেন এর কোনো কিছুই সহ্য করতে পারছিলেন না। সুরম্য প্রাসাদে বসে তার মনে হচ্ছিল, এ সব কিছুই বাড়াবাড়ি। অতএব সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। আর সে ইচ্ছা পূরণ করার জন্যই ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার তার গুণগান গাওয়ার জন্য দেশে মাত্র চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকি সব সংবাদপত্রের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে দেন। এ দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের এই সিদ্ধান্ত ছিল অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য। 
এখন কেউ কেউ এমন যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করছেন যে, একদলীয় সরকারের সাথে বহুসংখ্যক সংবাদপত্র যায় না বলেই শেখ মুজিবুর রহমান সংবাদপত্র ডিকারেশন বাতিলের অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। অর্থাৎ মতা নিরঙ্কুশ হবে। শেখ মুজিব যা কিছু অনাচার-অত্যাচার করেন না কেন, তার বিরুদ্ধে কোনোরূপ প্রতিবাদ করা যাবে না। জনগণের আকাক্সা! বিস্ময়করভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে তার মূল্য শূন্যের কোঠায় গিয়ে দাঁড়াল। 
তার আগে সংবাদপত্র দলনে হেন কোনো ইতর ব্যবস্থা নেই, যা শেখ মুজিবুর রহমান সরকার গ্রহণ করেনি। পত্রিকার সাব-এডিটর থেকে শুরু করে সম্পাদক পর্যন্ত কেউ তার সেই দলন-পীড়ন থেকে রেহাই পাননি। ডেইলি অবজারভার পত্রিকার সহসম্পাদক বাবুল রাব্বানী সে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। নির্যাতনের শিকার হয়ে জেলবন্দি হয়েছিলেন দৈনিক গণকণ্ঠের সম্পাদক দেশের প্রথিতযশা কবি আল মাহমুদ, সাপ্তাহিক হলিডের সম্পাদক মরহুম এনায়েতুল্লাহ খান, স্পোকস্ম্যান/মুখপত্র সম্পাদক ফয়জুর রহমান। এ ছাড়া ইস্টার্ন এক্সামিনার সম্পাদক, মওলানা ভাসানী প্রকাশিত হককথার সম্পাদক এরাও শেখ মুজিবুরের গরাদে বন্দী জীবনযাপন করেছেন। 
সেই দুঃসহকাল আবার ফিরে এসেছে। পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী, সরকারের দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহের দায়ে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুন হয়েছেন। সরকারি মাস্তানেরা প্রতিনিয়ত সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। কোনো কোনো দালাল এসব নিয়ে এলোমেলো কিছু কথাবার্তা বলছে। কিন্তু নিগ্রহ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সম্প্রচার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, টেলিভিশনের টক শোগুলো ভারি টক। এবং তারা অন্ধ। সরকারের কোনো উন্নতিই তারা দেখতে পায় না। ফলে টক শোগুলোতে এখন প্রিয় মানুষের মুখ দেখা যাচ্ছে না। এভাবেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হচ্ছে। কিন্তু প্রতিরোধও সর্বব্যাপী। সাংবাদিকেরা একেবারে চুপ করে থাকেননি। শেখ হাসিনা সরকারের পে শেখ মুজিবের মতো হয়তো সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয়। ধারণা করি, আরো নিগ্রহ অপেমাণ। 
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

এলোমেলো হয়ে গেছে সবকিছু



ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : 
সরকার এখন কে চালাচ্ছে, কে কখন কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সেসব ধুলায় অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রীদের কথার মধ্যেও কোনো সাজুয্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এক মন্ত্রী যদি বলেন, উত্তরে যাচ্ছি, আর একজন বলেন, দক্ষিণে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, দেশ বিদ্যুতে সয়লাব হয়ে গেছে। আবার প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টা বলেছেন, আগামী কয়েক বছরে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের কোনো সম্ভাবনাই নাই। কিন্তু সাধারণ মানুষ বিদ্যুতের দেখা পাচ্ছে না। তারা মিছিল, মিটিং, সভা, অবরোধ, ভাংচুর করছে। কোনো কোনো মন্ত্রী দাসানুদাস বিবেচনায় জনগণকে কষে গাল দিচ্ছেন। তারা যদি এরকম করতেই থাকে তাহলে যেটুকু বিদ্যুৎ দেয়া হচ্ছে সেটাও বন্ধ করে দেবে। মনে হয়, জনগণ তাদের ভাগ্য নিয়ন্তা নয়, ক্রীতদাস মাত্র। তাদের এসব বাড়াবাড়ি মহারাজ সরকার সহ্য করবে কেমন করে? টেলিভিশনে যারা টকশো করেন, কিংবা সভা-সমাবেশে যেসব সুধীজন জনগণের মতামত প্রতিফলন ঘটিয়ে বক্তব্য দেন, তাদের উপরও সরকার দারুণ খাপ্পা। প্রধানমন্ত্রী হুমকি দিয়েছেন, এক সপ্তাহ তাদের বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে হবে।
বিদ্যুতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পানির সমস্যা। বিশাল বিশাল এলাকা ও জনপদের গোটা অঞ্চলেই পানি নেই। গত কয়েকদিন ধরে তেজগাঁওয়ের শিল্পাঞ্চল পানিশূন্য। নগরীর অধিকাংশ এলাকায় পানির জন্য হাহাকার। মানুষ বিক্ষোভ করছে। মিছিল করছে। সরকারের দলীয়করণকৃত পুলিশ বাহিনী তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বিদ্যুৎ-পানি থাকতেই হবে এমন কি কোনো কথা আছে। নাই তো নাই। সরকার চেষ্টা করছে। সে চেষ্টায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুতের সমস্যা মিটাতে অর্থনীতিখেকো রেন্টাল পাওয়ারের আয়োজন করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, সেখান থেকে সরকারের লোকেরা চল্লিশ হাজার কোটি টাকা ইতোমধ্যে লুট করে নিয়েছে। এখন সেগুলোও অচল হয়ে পড়ছে। পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, রেন্টাল পাওয়ার স্টেশনগুলো চালালে এর মালিকদের যা লাভ, না চালালে তারচেয়েও বেশি লাভ।
এদিকে এগুলো সচল রাখার জন্য আমদানি করা হচ্ছে অতিরিক্ত শত শত কোটি টাকার জ্বালানি তেল। তাতে ভর্তুকি বিপুল। কন্টাক্ট-পাওয়া সরকারি লোকদের দুর্নীতির খাই মেটাতে জ্বালানি তেলের দাম প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে। নতুন বাসা বাড়িতে গ্যাস বিদ্যুতের সংযোগ না দেয়ায় হাউজিং কোম্পানিগুলো মাথায় হাত দিয়ে বসেছে। এদিকে আবার ভারতীয় ‘প্রতারক' কোম্পানি সাহারাকে উপশহর গড়ে দেয়ার জন্য এক লাখ একর জমি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশীয় আবাসন শিল্প মালিকরা। তারা বলছেন, জমি দিয়ে তারাই এমন উপশহর গড়ে তুলতে সক্ষম। ধরা যাক, সাহারা এই জমিতে উপশহর গড়ে তুলল। তাদের গ্যাস-বিদ্যুৎ কে দেবে? হয়তো সরকারই দেবে। দেশীয় শিল্প লাটে উঠবে।
এদিকে আবার এসব শিল্প ঘিরে গড়ে উঠেছে বহু সংখ্যক সাব-সিডিয়ারি শিল্প। যেমন: অ্যালুমিনিয়াম প্ল্যান্ট, উচ্চমানের কাঁচ শিল্প।  এসব শিল্পে বাংলাদেশের শ্রমিকরা কাজ করে। অথচ সাহারা গ্রুপ তাদের সকল নির্মাণসামগ্রী নিয়ে আসবে ভারত থেকে। এমনকি ভারত থেকে আসবে লাখ লাখ শ্রমিকও। তাতে বাংলাদেশের লোকেরা কুলি-মজুরের কাজও পাবে কিনা সন্দেহ আছে। ভারতের সঙ্গে দ্বিগুণ সুদে ভারতের স্বার্থে যে শতকোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে তার শর্তগুলোও এমনই। এর সকল উপকরণ ভারত থেকে আমদানি করতে হবে এবং ভারতই এসবের মূল্য নির্ধারণ করবে। প্রতিযোগিতা মূল্যে বাইরে থেকে কিছুই কিনতে পারবে না বাংলাদেশ। তাতে যে ভারত দুই টাকার মাল দশ টাকা বলবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু বাংলাদেশ এর প্রতিবাদও করতে পারবে না। অর্থাৎ বিশ কোটি ডলার দিয়ে বাকি আশি কোটি ডলার ভারত আগেই গাপ করে দিতে পারবে। তারপর বাংলাদেশকে ঐ একশ' কোটি ডলার সুদসমেত প্রায় দেড়শ' কোটি ডলার শোধ করতে হবে। কী আজব তামাশা! এই নির্মাণ কাজের সকল দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকও আসবে ভারত থেকেই। বাংলাদেশের লোকেরা বড়জোর কুলি মজুর হবে।
সাহারা যদি উপশহর নির্মাণ করেও তাহলে বাংলাদেশে তা কেনার লোকের অভাব হবে। তখন সরকার সম্ভবত জনগণকে না জানিয়েই আইন করবে যে, ভারতীয়রা সে ফ্ল্যাট কিনতে পারবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে এখানে ভারতে স্থায়ী উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে।
দেশের শিল্পকারখানা নিয়েও সরকার তেলেসমাতি চালিয়ে যাচ্ছে। শিল্পকারখানায় গ্যাস-বিদ্যুৎ নেই। সরকার ঘোষণা করেছে চার টাকার বিদ্যুৎ শিল্পমালিকরা যদি ১৫ টাকায় কিনতে রাজি থাকেন, তাহলে তাদের নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ দেয়া হবে। তাতে বাংলাদেশে উৎপাদিত শিল্পপণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়াবে। এই ফাঁকে ভারত দখল করে নেবে বাংলাদেশের বাজার। বন্ধ হবে দেশীয় শিল্প। বেকার হবে লাখ লাখ শ্রমিক। এর বিপদ সম্পর্কে ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা সম্ভবত কিছুই আঁচ করতে পারছে না। দেশে যখন কর্মসংস্থান বন্ধ হবে, আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হবে। তখন লাখ লাখ মানুষ ভারতের দিকেই ধাবিত হবে। যে ভারতের আশি কোটি লোকের আয় দৈনিক বিশ-বাইশ রুপি, যেখানে ৭০ কোটি লোকের পায়ে জুতো নেই, নেঙটি পরে চলে, যেখানে সমপরিমাণ লোক খোলা জায়গায় প্রাকৃতিক কাজ সম্পাদন করেন, সেখানে আরও লাখ কর্মপ্রার্থী নতুন করে যুক্ত হলে ভারতের অর্থনীতি কী ভয়াবহ চাপের মুখে পড়বে সেটা অনুধাবন করার শক্তি সেখানকার আধিপত্যবাদী সরকারের নেই বলেই মনে হচ্ছে।
এদিকে বেপরোয়া দলীয়করণের ফলে প্রশাসন এবং রাষ্ট্রের স্তম্ভগুলো মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তারা পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। বিচারক রাস্তার মধ্যে পুলিশকে কান ধরে উঠবস করিয়েছেন। পুলিশ গত রোববার এক বিচারককে লাঠিপেটা করেছে। তার আগে প্রশাসন ক্যাডারের লোকদের পুলিশ বেধড়ক পিটিয়েছে। এক বিচারক সংসদের স্পিকারকে অশিক্ষিত ও রাষ্ট্রবিরোধী বলে উক্তি করেছেন। সংসদ সদস্যরা তার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ঐ বিচারককে অধিশংসনের দাবি জানিয়েছেন। স্পিকার সম্ভবত ঠিকই বলেছেন যে, সর্বত্র একটা ‘কী যেনো হনুরে ভাব'। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে মনে হয়েছে, তিনি জাতীয় সংসদের নয়, পুলিশ ও বিচারকদের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। কারণ তাদের মাধ্যমে বিরোধী দল দমনে অনুকূল ব্যবস্থা নেয়া রায় পাওয়া সম্ভবত তার জন্য সহজ। আমরা লক্ষ্য করেছি, সাধারণের দৃষ্টিতে বিবেচ্য বিষয় নয়, এমন বিষয়ে আদালত উপযাচক হয়ে রায় দিয়েছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীরা সেসবের তীব্র সমালোচনাও করেছেন।
এমনি একটা পরিস্থিতিতে সরকারকে বিরোধী দল নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য ১০ জুন পর্যন্ত আলটিমেটাম দিয়েছিল। এমনকি মহাজোট সরকারের মিত্ররা পর্যন্ত মনে করেন যে, একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া দরকার। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক মুন সিনেমা হলের মালিকানা ফেরতের মামলায় সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণতহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা ত্রাণ গ্রহণকারী এই খায়রুল হকই অসাংবিধানিক বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেন। যদিও তিনি তার রায়ে বলেছিলেন যে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পরবর্তী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে পারে। এই রায় হাতে পাওয়া মাত্রই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য জামায়াতে ইসলামীর হাত ধরে শেখ হাসিনাই রাষ্ট্রধ্বংসী আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। আর তাতেই শেষ পর্যন্ত বিএনপি ১৯৯৬ সালে ক্ষণস্থায়ী সংসদে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রণয়নে বাধ্য হয়।
এখন সেই সরকারব্যবস্থারই তুমুল নিন্দা করে তা আর পুনঃপ্রবর্তন না করার পক্ষে মুহুর্মুহু বক্তব্য রেখেছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, আগামী নির্বাচন দলীয় আওয়ামী লীগের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। তাই যদি হয় তাহলে সে নির্বাচনে বিএনপি বা জামায়াতের মতো শক্তিশালী দলগুলোর অংশগ্রহণের কোনো প্রশ্নই উঠে না। আওয়ামী লীগের দীর্ঘকালের মিত্র হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ আশা করছেন যে, ঐ নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশ গ্রহণ না করে, তবে তিনিই হবেন প্রধান বিরোধী দল। সে কারণেই তিনি ভারতের পরামর্শে সরকারের বিরুদ্ধে দু'চার কথা বলতে শুরু করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্ব বলছে যে, সকল দলের অংশগ্রহণে তারা এদেশে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠান দেখতে চায়। প্রধান সকল দল অংশ না নিলে সে নির্বাচন কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এগুলোকে আওয়ামী লীগ ভারতপ্রীতির কারণে কোনোভাবেই আমলে নিচ্ছে না। ভারতও নিজস্ব স্বার্থে সবসময় তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে। এখন তারা বলছে, যেকোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকে তারা রক্ষা করবে। এ কথা তারা ১/১১-তে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় আরোহনকারী জেনারেল মইনের ক্ষেত্রেও বলেছিল। জেনারেল মইনকে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা দিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে তারা বলেছিল যে, বাংলাদেশে ভারতের এতবড় বন্ধু কখনও আসেনি। কিন্তু জেনারেল মইন যখন ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেন, তখন ব্যবহৃত টিস্যু পেপারের মতো ভারত তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। সে লক্ষণ এখন অস্পষ্ট নয়। শেখ হাসিনার কাকা ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশে এসে কোনোদিন বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎও করেননি। সেই প্রণব এবার এসে সাক্ষাৎ তো করেছেনই, এবং বলেছেন, ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব চায়। কোনো দলের সঙ্গে নয়। এসব বার্তার মর্মার্থ চরম ব্যর্থ সরকার উপলব্ধি করতে পারে কিনা জানি না।
এর আগে সারাদেশে সফল রোডমার্চ কর্মসূচি শেষে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল গত ১২ মার্চ ঢাকায় মহাসমাবেশ ডেকেছিলেন। এই মহাসমাবেশকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য সরকার এক সপ্তাহ আগে থেকেই সারাদেশকে ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। ঢাকার সঙ্গে সমস্ত সড়ক, নৌযোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ঢাকা মহানগরীর সমস্ত হোটেলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তারা যেন নতুন কোনো বোর্ডারকে থাকতে না দেন। মানুষ অবর্ণনীয় দুর্দশার শিকার হয়েছিল। এবার বিএনপির নেতৃত্বাধীন আঠারো দলীয় জোট ১০ জুনের মধ্যে নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে না নিলে ১১ জুন ঢাকায় গণসমাবেশের ডাক দেয়। ধারণা করা হয়েছিল, সরকার সম্ভবত এবার আর কোনো বাধা দেবে না। নির্বিঘ্নে গণসমাবেশ হতে দেবে। কিন্তু ১০ জুনই সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এবং আবারও ঢাকামুখী সড়ক-নৌপথের সকল যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। হোটেলগুলোতে আগের মতোই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সরকার এখন মনে করছে, জনগণই এখন তাদের শত্রুপক্ষ। জনগণ যদি শত্রুপক্ষ হয়, তাহলে ক্ষমতায় থাকার উপায় কী? কূটকৌশল? এগুলো শেষ পর্যন্ত ফলদায়ী হয় না। চূড়ান্ত বিচারে জনগণই জয়ী হয়। সরকারের সে উপলব্ধি হলে ভাল হতো।

শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

সংসদ-আদালত যখন মুখোমুখি

সংসদ-আদালত যখন মুখোমুখি



॥ ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ॥

আমরা সাধারণ নাগরিকেরা আদালত কিংবা সংসদ উভয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমরা বিবেচনা করে থাকি যে, আদালতই আমাদের শেষ আশ্রয়। সরকার কিংবা প্রশাসন, চোর-ডাকাত-খুনি যার মাধ্যমে আমরা বিপদগ্রস্ত হই না কেন আদালতই আমাদের শেষ ভরসাস্থল। কিন্তু সর্বত্র দলীয়করণের ফলে এখন আমরা ক্রমেই যেন ভরসা হারিয়ে ফেলছি। জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় সদস্যরা যে ভাষায় যা বলেন, তাতে মাথা হেঁট হয়ে যায়। তারা জনগণের প্রতিনিধি। কিন্তু জনগণ বোধ করি ভাবতেও পারেনি যে, জাতীয় সংসদে গিয়ে তারা এতটা অশালীন ও রূঢ় হবেন। কখনো কখনো জানা সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য তারা হেন ভাষা নেই যা প্রয়োগ করেন না। সেগুলো অশ্রাব্য ও কুরুচিপূর্ণ। এতে অতিষ্ঠ হয়ে স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন যে, আপনাদের ভাষা শুনে মনে হয় আপনারা কোথা থেকে এসেছেন। 
পৃথিবীর সব দেশেই জাতীয় সংসদে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। হাতাহাতি যে হয় না, তেমনও নয়। কিন্তু অধিকাংশ সংসদে অন্যকে আক্রমণের ভাষা হয় ইঙ্গিতবহ ও হাস্যরসাত্মক। কখনো সেসব ভাষা শুনে সে দেশের মানুষ সশব্দে হাসেন, কখনো বা মুখ টিপে। কিন্তু এখন বাংলাদেশে যারা সংসদ সদস্য হয়ে এসেছেন, তাদের অনেকেই সে জ্ঞানবুদ্ধি রাখেন বলে মনে হয় না। তা ছাড়া এরা কিছুতেই মনে রাখতে চান না যে, ঢিলটি মারলে পাটকেলটি খাওয়ার আশঙ্কা থাকে। 
তা সত্ত্বেও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জাতীয় সংসদই গোটা দেশের জনগণের ভালো-মন্দের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আর আইনও তারাই প্রণয়ন করেন। প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করেন। এখানে তারা বিচারকদের মতা নির্ধারণ করে দেন। বিচারকেরাও সংবিধান নির্ধারিত আইনের বাইরে অন্য কোনো মতা প্রয়োগের অধিকার রাখেন না। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর আগে অন্য বিচারক নিয়োগের েেত্র প্রধান বিচারপতির পরামর্শ গ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী যখন পাস করা হয়, তখন প্রধান বিচারপতির সে মর্যাদা ও মতা কেড়ে নেয়া হয়। ওই সংশোধনীবলে রাষ্ট্রপতি নিজেই প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে সব বিচারপতি নিয়োগের মতা নিজ হাতে নিয়ে নেন। ওই সংশোধনী প্রস্তাব জাতীয় সংসদই পাস করেছিল। ফলে বিচার বিভাগের উচ্চবাচ্য করার কোনো মতা ছিল না। তারা অবনত মস্তকে সেটা মেনে নিয়েছিলেন। 
বিচার বিভাগকে সংবিধান যে মতা দিয়েছে সেখানে আদালত নিঃসন্দেহে সার্বভৌম। আবার সংবিধান প্রণয়ন, তার সংশোধন, বিচার বিভাগের মতা নির্ধারণ সেসবই সংসদেরই দায়িত্ব। সেখানে সংসদই সার্বভৌম। উভয় প্রতিষ্ঠানকে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি। কিন্তু সম্প্রতি আমরা এর বড় ধরনের ব্যত্যয় ল করছি। 
আদালতের কোনো কোনো রায় আমাদের মতো আইন-অনভিজ্ঞ মানুষের বোধের অগম্যই থেকে যাচ্ছে। যেমন মুন সিনেমা হলের মালিকানা দাবি করেছিলেন এর প্রকৃত মালিক। আদালত সেটি মঞ্জুর করে সিনেমা হলটি তার মালিককে ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক এই নির্দেশ দিতে গিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে দেন। আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা বুঝতে পারিনি যে, মুন সিনেমা হলের মালিকানা ফিরিয়ে দেয়ার সাথে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের সম্পর্ক কী। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে বিচারপতি খায়রুল হক সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছিলেন। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠল, যে গণতান্ত্রিক চেতনা ধারণ করে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল। সংবিধানের চতুর্র্থ সংশোধনী তথা একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠায় যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেটিও তো সংবিধানের মূল চেতনার একেবারে বিপরীত ছিল। খায়রুল হক যদি তখন চতুর্থ সংশোধনী বাতিল করতেন, তাহলে বোঝা যেত যে, তিনি ন্যায়বিচার করলেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালের শেষাশেষি জারি করা চতুর্থ সংশোধনী বহাল রাখায় এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনকালে জারি করা পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা সিদ্ধান্তটিকে জনগণের কাছে রাজনৈতিক একদেশদর্শী মনে হয়েছে। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই যে, ওই রায়ের পর প্রায় দু’বছর অতিবাহিত হলেও মুন সিনেমা হলের মালিককে এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি কিংবা তিনি হলটি ফেরত নিতেও আসেননি।
অথচ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক প্রথা আবার প্রবর্তিত হয়েছিল এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আবার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। বিচারপতি খায়রুল হক পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় দিলেও সেখানে যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার বিধান ছিল, সেগুলোকে বহাল রাখেন। এতে খুব সঙ্গতভাবেই আদালতের রায় নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। 
অপর দিকে বিচারপতি খায়রুল হকই আর এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানপরিপন্থী ঘোষণা করে তা বাতিল করে দিয়েছেন। কিন্তু এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে এ দেশে পরপর তিনটি সফল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যাতে সব রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে এবং দেশে-বিদেশে সে তিনটি নির্বাচন সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়েছে বলে অভিহিত করা হয়। সেটি বাতিল করে দেশে এক চরম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ডেকে আনা হয়েছে। আদালত তো অনেক কিছুই বিবেচনায় নেন। এমনকি বিচার ও দণ্ড দেয়ার েেত্রও তারা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন। সেভাবে কারাগারে রাখার েেত্রও কাউকে ডিভিশন দেয়া হয়। কাউকে কাউকে তা দেয়া হয় না। অর্থাৎ দেশ-কাল-ব্যক্তি কোনোটাই আদালতের দৃষ্টির বাইরে নয়।
সাম্প্রতিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে সড়ক ভবন দ্রুত সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে হাইকোর্টের নির্দেশকে কেন্দ্র করে। হাইকোর্ট সড়ক ভবন ৫ জুনের মধ্যে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু গত ২৯ মে মঙ্গলবার মাগরিবের পর জাতীয় সংসদে এ বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, ৫২ বছরের অবস্থান থেকে এটা রাতারাতি সরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। তিনি প্রশ্ন করেন, সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা থাকুক, আদালত কি তা চাইছেন না? এ ব্যাপারে আদালতকে সহনশীল হওয়ার আহ্বান জানান শাহরিয়ার আলম। এরপর পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে মহাজোটের (জাসদ) সংসদ সদস্য মইনুদ্দিন খান বাদলও আদালতের বিভিন্ন বিষয়ের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, প্রত্যেককেই একটি মাত্রায় আসতে হবে। আইনকে অনেক েেত্রই অন্ধভাবে উপস্থাপন করা হয়। আইনটির প্রকৃত ব্যাখ্যা প্রয়োজন। 
এ বিষয়ে স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, আদালতের রায়ে জনগণ ুব্ধ হলে বিচার বিভাগকেও তারা রুখে দিতে পারে। সরকার স্বৈরাচারী হলে জনগণ রুখে দাঁড়াতে পারে তাদের বিরুদ্ধেও। তাই কারোরই এমন ভাবসাব হওয়া ঠিক নয় যে, আমি মতা পেলাম, একটা কিছু দেখাই। জনগণের রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস আছে। আমি কি হনুরে ভাবসাব ঠিক নয়। কোনো ভাব না দেখিয়ে সবারই উচিত দায়িত্ব পালনের মনোভাব রাখা। তিনি বলেন, আদালত নিরপে ও স্বাধীন। কিন্তু দেশের মানুষের বিচারের েেত্র বছরের পর বছর লেগে যাবে, আর নিজেদের বিষয় হলে বিচার বিভাগ ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবেন এটা ভালো দেখায় না। কেবল নিজেদের বিষয়টি দেখলে সরকার কিভাবে চলবে? সরকারকেও সহযোগিতা করতে হবে। স্পিকার বলেন, আমি যদি মনে করি সংসদই সর্বোচ্চ মতার অধিকারী, সরকার যদি মনে করে তারাই সর্বোচ্চ মতার অধিকারী, আর আদালত যদি মনে করেন যা ইচ্ছা তা করবেন এটা ঠিক নয়। 
হাইকোর্টের বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক ও বিচারপতি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চ স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল ও আদালত অবমাননাকর বলে মন্তব্য করেছেন। একই সাথে সংবিধান ও বিচার বিভাগ সম্পর্কে স্পিকারের ন্যূনতম জ্ঞান নেই বলে আদালত মন্তব্য করেছেন, সংসদের অভিভাবক হলেন স্পিকার। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুসারে তিনি রাষ্ট্রের তিন নম্বর ব্যক্তি। অথচ তার সংবিধান, সংসদ ও আদালত সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান নেই। তাই ওই পদে থাকার যোগ্যতাও তার নেই। 
আদালত বলেছেন, সংবিধান অনুসারে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে। আদালত বলেন, আমি কি হনুরেÑ এটা কোনো সংসদীয় ভাষা হতে পারে না। স্পিকার একজন আইনজীবী। তিনি কি জানেন না, বিচারাধীন বিষয়ে উচ্চ আদালতের সমালোচনা করা যায় না। কোর্টের রায়ে জনগণ যদি ুব্ধ হয়, তাহলে বিচারকের বিরুদ্ধে একসময় রুখে দাঁড়াতে পারেÑ স্পিকারের এ মন্তব্যের সমালোচনা করে আদালত বলেন, এটা পুরোপুরি আদালত অবমাননাকর। জনগণকে তিনি উস্কে দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল অপরাধ করেছেন। স্পিকার বিচারাধীন বিষয়ে কোনোভাবেই সংসদ সদস্যদের উস্কে দিতে পারেন না। আইনজীবী হিসেবে স্পিকারের বার কাউন্সিলের সনদ থাকা উচিত কি না তা নিয়েও এখন ভাবতে হবে। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বা সরকারের কোনো সংস্থা বিচার বিভাগকে ব্যবস্থা নিতে বলার কে? একটি বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে আদালত বলেন, স্পিকার কোনো দিন এই বই পড়েছেন কি না সন্দেহ আছে। এই বই দূরে থাক, এখন মনে হচ্ছে সংবিধান ও আদালত সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান স্পিকারের আছে কিনা? স্পিকারের বক্তব্য শুধু অজ্ঞতাই নয়, তার বক্তব্য অমার্জনীয়। আমরা তার বক্তব্যে হতবাক হয়েছি। দায়মুক্তির অপব্যবহার তিনি করতে পারেন না। এ সময় সাবেক আইনমন্ত্রী আদালতে বলেন, স্পিকার সংসদের প্রতীক। আদালত বলেন, ওই প্রতীক হতে হলে যোগ্যতা থাকতে হয়। লেখাপড়া থাকতে হয়। তিনি বিচারাধীন বিষয়ে আলোচনায় শরিক হয়েছেন। এ সময় সিনিয়র আইনজীবীরা হাতজোড় করে আদালতকে অনুরোধ জানান যে, বিচার বিভাগ ও সংসদকে যেন মুখোমুখি দাঁড় করানো না হয়। 
বিচারপতি জনাব মানিকের এ রকম বক্তব্যের পর সংসদে বিষয়টি নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা হয়। সিনিয়র সংসদ সদস্যরা আগামী তিন দিনের মধ্যেই বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের অপসারণের আলটিমেটাম দিয়েছেন। তারা বলেন, তা না হলে সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের অভিশংসনের মতা আবার সংসদে ফিরিয়ে আনা হবে। তারা বলেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন হতে পারে। কিন্তু তারা সংবিধান ও সংসদের ঊর্ধ্বে নয়। তারা ওই দুই বিচারপতিকে নিঃশর্ত মা প্রার্থনা করতে বলেন। 
গত ৫ জুন বিকেলে সংসদ অধিবেশন বসার পর থেকেই সংসদ যেন ফুঁসছিল। এতে বক্তব্য রাখেন তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মইনুদ্দিন খান বাদল ও মুজিবুল হক চুন্নু। তোফায়েল আহমেদ বলেন, একজন স্যাডিস্ট বিচারককে মেনে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই বিচারক মানুষকে কষ্ট দিয়ে মজা পান। সালাম না দেয়ায় পুলিশকে রাস্তায় কান ধরে ওঠবস করানো ছাড়াও তিনি বিমানের তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট কিনে কিভাবে সামনের সারিতে আসন চান, সেটি আমরা দেখেছি। তিনি হয়তো কোনো একদিন সংসদ সদস্যদেরও একইভাবে দাঁড় করিয়ে রাখতে চাইবেন। বিচারপতিদের বুঝতে হবে, বিচারপতিদের বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা। তিনি বলেন, অবাক হয়ে গেলাম কিভাবে একজন বিচারক সংবিধান লঙ্ঘন করেন? তাহলে কি বিচার বিভাগ সংসদের ঊর্ধ্বে উঠে গেল? আর এর আগের বার এই বিচারপতিকে আওয়ামী লীগ চাকরি দিয়েছিল। কিন্তু জোট সরকার তার চাকরি স্থায়ী করেনি। এবার আওয়ামী লীগ এসে তার চাকরি কনফার্ম করেছে। আর তিনিই কি না একজন মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে এ রকম কথা বলেন!
শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, বিচারপতিরা সংবিধানের ওপর সার্বভৌম হতে পারে না। তারা সংসদের ঊর্ধ্বে নন। এ ধরনের আদেশকে আমরা সংসদের ওপর বিচার বিভাগের নগ্ন হস্তপে মনে করি। বিচার বিভাগের হাত লম্বা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তাদের হাত সংসদের চেয়েও লম্বা। স্পিকারকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলা মানে সংসদ, সাড়ে তিন শ’ সংসদ সদস্য, সরকারÑ সবাইকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল করা। সংসদের ওপর বিচার বিভাগের হাত নেই। স্পিকারকে অপমান করার মতা বিচার বিভাগের নেই। এই বিচার বিভাগের মা চাওয়া উচিত। সংসদের ওপর হস্তপেকারী ওই বিচারককে বিচার বিভাগ থেকে প্রত্যাহার করে সংসদের সার্বভৌমত্ব রা করতে চাই। মহাজোটের এমপি রাশেদ খান মেনন বলেন, বিচারপতি স্পিকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ করে জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব ও অধিকারের ওপর হস্তপে করেছেন। সংবিধান-সংসদকে অবহেলা করেছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এই বিচারপতিকে অভিশংসন করার জন্য প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেছেন। জোটভুক্ত জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্ন বলেন, সামান্য কারণে ওই বিচারপতি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। সব কিছু দেখে মনে হয়েছে তিনি মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। তার অভিশংসন হওয়া প্রয়োজন। 
এ দিকে সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ করেছেন, এই বিচারপতি তাকে আদালতে প্রকাশ্যে বানর বলেছেন এবং পাঁচ শতাধিক আইনজীবীকে অপমানজনক ভাষায় কথা বলেছেন। ফলে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী মানিককে অপসারণের জন্য লিখিতভাবে আবেদন জানিয়েছেন। এই আবেদনের কপি তিনি প্রধান বিচারপতিকেও দিয়েছেন। 
আমরা এত সব উদ্ধৃতি দিলাম এই কারণে যে, প্রশাসন কিংবা বিচার বিভাগ দলীয়করণের ফল কী হয় সরকার সম্ভবত বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারবে এবং আশা করি বিএনপি কেন তার নিয়োগ স্থায়ী করেনি তার যৌক্তিকতাও সরকার উপলব্ধি করবে। সংসদে বিএনপি বা বিরোধী দল বলে কিছু ছিল না। ছিলেন সরকারদলীয় ও মহাজোটের সদস্যরা। এই বিচারপতি সম্পর্কে তারাই এত সব মন্তব্য করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কি বোধোদয় হবে? 
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com