মঙ্গলবার, ৮ মে, ২০১২

খুঁচিয়ে ঘা করছে সরকার



ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী :
 সমাজে হাজারো অঘটন প্রতিনিয়ত ঘটছে। গুম এখন সরকারি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। শোনা যায়, অর্থের বিনিময়ে যে কাউকে যে কোনো সময় আইনসিদ্ধভাবেই গুম করে ফেলা যায়। দ্রব্যমূল্য প্রতিনিয়ত বাড়ছে। গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কট বাড়ছে। ডিজেল-পেট্রোলের দাম বেড়েছে। আরও বাড়বে। গোটা সমাজ, প্রশাসন দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ ও তার ছানাপোনাদের সন্ত্রাসে অনিরাপদ হয়ে উঠেছে গোটা জনপদ। বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে হেন কোনো পদ্ধতি নেই যা সরকার ব্যবহার করছে না। হামলা-গ্রেফতারেও কাজ হচ্ছে না। কোথা থেকে পঙ্গপালের মতো মানুষ ছুটে এসে বিরোধী দলের কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছে। এখন চলছে মামলা। আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সরকার তার অপকর্ম ধারাবাহিকভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে। আদালতের এমন নির্লজ্জ দলীয়করণ এদেশে আর কেউ কোনোদিন দেখেনি। দলীয়ভাবে হয়তো নিয়োগ হয়েছে, কিন্তু তারা যখন শপথ নিয়ে বিচারকের আসনে বসেছেন, তখন বিচারকের মর্যাদার কথাটা তারা স্মরণে রেখেছেন। এখন সে মূল্যবোধ উধাও হয়ে গেছে। কোনো কোনো বিচারক কখনও কখনও এমন ভাষায় কথা বলছেন বলে অভিযোগ রয়েছে যাতে চমকে ওঠার অবস্থা। চোর-খুনি-ডাকাত-বাটপার-লুটেরা-ঘুষখোর সবকিছু সরকারের মদতে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলে ফেঁপে সমাজকে গিলে খাওয়ার চেষ্টা করছে। মূল্যবোধকে আইনের মাধ্যমেই অবক্ষয়িত করা হচ্ছে।
যে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যের কারণে এই বঙ্গভূমি পূর্ব পাকিস্তান হয়েছিল, তারপর হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ, সেই স্বাতন্ত্র্যের বিলোপ সাধনের জন্য প্রতিনিয়ত সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যই যদি না থাকতো, তাহলে পূর্ব বাংলার মানুষও আসামের অন্তর্ভুক্ত বৃহত্তর সিলেটের জনসাধারণ পাকিস্তানের পক্ষে যাবার জন্য ভোট দিত না। স্বাধীন বাংলাদেশও প্রতিষ্ঠিত হতো না। এই জনপদও যদি হিন্দু অধ্যুষিত হতো তাহলে বাংলাদেশের পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার প্রশ্নই উঠতো না। ভারতের সঙ্গে একাকারই থাকতো। এখন সবকিছু ভুলিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করছে সরকার। অর্থাৎ এই সরকারের অধীনে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব এখন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে দেশে চলছে প্রহসন। তথাকথিত সাক্ষীর পুলিশী জবানবন্দীকেই সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করার বিধান চালু করা হয়েছে। আদালতে তাদের হাজির করার প্রতিষ্ঠিত ও শতাব্দী প্রাচীন আইন ও নিয়মাবলী লঙ্ঘন করা হচ্ছে এবং ন্যায়বিচারের রেওয়াজ বিলুপ্ত করা হয়েছে। আসামী পক্ষ তাদের জেরা করার কোনো সুযোগ পাচ্ছে না। তারা সত্য না মিথ্যা বলছে, তাদের বক্তব্য মতলবী কিনা, অর্থবিত্তের প্রলোভন কিংবা জুলুম নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে কথা আদায় হয়েছে কিনা যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে তা প্রমাণের এখন আর কোনো প্রয়োজন নেই। কিংবা সত্যি সত্যি এরকম কোনো সাক্ষী আছে কি না, নাকি সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নির্মূলের প্রয়াসে এমন বানোয়াট জবানবন্দী তৈরি করেছে, তাও আর প্রমাণ করা যাবে না। এমন সব সাক্ষীর জবানবন্দী আনা হয়েছে যারা চল্লিশ বছর আগে ভিন্ন দেশের অভিবাসী হয়ে চলে গেছেন। এরা অনেকটা উপন্যাসের চরিত্রের মতো। এখন মনে হচ্ছে যুদ্ধাপরাধের বিচার উপন্যাসের ভিত্তিতে সম্পন্ন করার চেষ্টা করছে সরকার। বিরোধী দল নির্মূলে এ একটা পদ্ধতি বটে। একেক দলের ক্ষেত্রে একেক ব্যবস্থা। রাজাকার মানেই যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধ হতে পারে না।
এ বিচারের যখন আয়োজন করা হয়, তখন সারা পৃথিবী সোচ্চার হয়ে ওঠে। এর নাম দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩। যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইবুনাল। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠনের এবং তার নিয়মনীতির কোনো কিছুই সরকার মান্য করেনি। সারা পৃথিবী প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে সরকার জানিয়ে দেয় যে, এটা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল নয়। এটা ডোমেস্টিক বা অভ্যন্তরীণ ট্রাইব্যুনাল। যেন এতেই পৃথিবীর মুখ বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ হয়নি। এখনও বিশ্বব্যাপী এই প্রহসনকে মানবতাবিরোধী বলে অভিহিত করা হচ্ছে। কিন্তু সরকার বেপরোয়া।
ভারত আছে পাশে। অতএব পৃথিবীর আর কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্কের দরকার নেই সরকারের। ফলে নিকট প্রতিবেশী চীন দূরবর্তী হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে সরকারের প্রতি ঘৃণা সঞ্চার হয়েছে। সেখানেও নতুন জনশক্তি নিয়োগ তো বন্ধ হয়েছেই, পুরনো যারা আছে তাদেরকেও দলে দলে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। সৌদী কূটনীতিক খুনের ঘটনার কোনো কিনারাই করতে পারেনি সরকার। তাদের তদন্ত দল এসেছিল। বাংলাদেশের অর্থহীন তদন্ত কার্যক্রমে তারা বিস্ময় আর হতাশা নিয়ে ফিরে গেছেন। ফলে যেটা হয়েছে, গোটা মধ্যপ্রাচ্য এখন বাংলাদেশের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কুয়েতের পরিস্থিতি কিছুটা সহনশীল ছিল। এখন সে কুয়েতও বাংলাদেশীদের দল বে্ধে ফেরত পাঠাচ্ছে। ১৫/২০ বছর যারা সেখানে ব্যবসায়-বাণিজ্য করেছেন, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তারা দেশে এলে আর ফেরত যেতে পারছেন না। অনেককে কুয়েতের বিমানবন্দর থেকে ফিরতি ফ্লাইটে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ফলে রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে পড়ছে সম্পন্ন মানুষ।
এদিকে সরকারের কোনো মনোযোগ আছে বলে মনে হয় না। এদের পূর্বসূরি এদেরই ডেকে আনা মীরজাফর মইনের সরকারের সময় থেকেই এই ধস শুরু হয়েছিল। তখন তাদের এক অর্বাচীন উপদেষ্টা ইফতেখার চৌধুরী গলা ফুলিয়ে বলেছিলেন যে, মধ্যপ্রাচ্য যদি জনশক্তি না নেয়, না নেবে। আমরা সারা পৃথিবীতে বাজার তৈরি করে সে ক্ষতি পুষিয়ে নিবো। অক্ষমের কী অদ্ভূত পিঁচুটি। এসব বালখিল্য কথায় কোনো লাভ হয়নি। বাজার সঙ্কুচিত হতে হতে বর্তমান পর্যায় নেমে এসেছে। ফলে গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কেবলই হ্রাস পাচ্ছে। শেয়ার বাজারে ৩৩ লক্ষ প্রান্তিক বিনিয়োগকারীর প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা কারসাজি করে হাতিয়ে নিয়ে গেছে। সরকার তাদের ধরার বদলে কোলে নিয়ে লালন করছে।
দ্রব্যমূল্য বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য আকাশ ছুঁয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যতই বলেন, দাম কমিয়ে একেবারে মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে এসেছেন। সেসব কথা লোকে শোনে বটে, কিন্তু সম্ভবত এ ধরনের বক্তব্যে তারা করুণাই করে। খুশি হয় না। তিনি পয়সা দিয়ে লোকজন জড়ো করে এমন অমৃত বচন যখন শোনান, তখন টিভি ক্যামেরায় তাদের ম্লান মুখ প্রধানমন্ত্রীর চোখে পড়ে না। কিন্তু তা জনসাধারণের দৃষ্টি এড়ায় না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়িয়েছেন। কিন্তু বিদ্যুৎ থাকে না। এই লিখতে বসেছি, বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘণ্টা-দেড় ঘণ্টা পর হয়তো আবার আসবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ঘরে ঘরে চাকরি দেবেন। বিদ্যুতের অভাব দূর হয়ে যাবে। কৃষককে বিনামূল্যে সার দেওয়া হবে। প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করা হবে। দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনা হবে। আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতির স্বর্ণযুগের সূচনা হবে। মানুষ যা কিছু কল্পনা করতে পারে, তার সবকিছু তিনি তাদের হাতে তুলে দেবেন। কিন্তু বাস্তবে আমরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্রই দেখতে পাচ্ছি। তাতেও সরকারের সিনাজুরির কমতি নেই। কিছু অশিক্ষিত লোক এখন আওয়ামী মুখপাত্র। তাদের কথা শুনলে ঘৃণায় গা রি রি করে ওঠে। জনগণ নিদারুণ অসহায় অবস্থায় পড়েছে। কোথায়ও কোথায়ও সরকারি দল নিজেই ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নিষ্কম্প হাতে তারা মানুষ খুন করছে। গুম করছে।
উপরন্তু যে ইসলাম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি, তার নিশানা মুছে দেওয়ার সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা তারা তুলে দিয়েছে। এখন ইসলামের মৌল নীতিগুলোতেও পরিবর্তন আনার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। আমরা জানি যে, কোনো মুসলমান ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে বিয়ে করতে পারে না। আগে তাদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। সরকার সে বিধান পরিবর্তন করে এখন ব্যবস্থা করেছে যে, যার যার ধর্মে থেকেও বিয়ে করা যাবে। আর এজন্য নিয়োগ করা হয়েছে হিন্দু কাজী। যারা মুসলমানের বিয়েও পড়াতে পারবে। বিয়ে রেজিস্ট্রেশনটা আইন। কিন্তু বিয়ে পড়ানো ধর্মের বিধান। হিন্দু কাজী কেমন করে কি খুতবা ও দোয়া-দরুদ পড়ে মুসলমানের বিয়ে সম্পাদন করবেন। সরকারের এসব কার্যক্রম অকারণে মুসলমানের ধর্ম ও ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করার শামিল। কিন্তু নিষ্কম্প চিত্তে সরকার এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের কর্তব্য হলো সর্বশক্তি দিয়ে এখনই এই সরকারকে প্রতিহত করা। সে সংগ্রামে জয় আমাদের অবধারিত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন