বুধবার, ১৬ মে, ২০১২

এ কেমন স্বদেশ! এ কেমন শাসন!


ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
ক্রমেই অচেনা মনে হচ্ছে আমাদের এই মাতৃভূমিকে। সরকার এদেশের ষোল কোটি মানুষকে যেন নিজ দেশেই পরবাসী করে ফেলছে। প্রশাসন, পুলিশ এমনকি বিচার বিভাগকে পর্যন্ত অচেনা মনে হতে শুরু করেছে। সরকার দাবি করে আসছে যে, জনগণের ভোটেই নাকি তারা নির্বাচিত হয়েছে। কিন্তু জনগণের আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-সাধ সব কিছুকে পদদলিত করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। এখানে লুটেরা, ঘাতক, দুর্নীতিবাজেরা শাস্তি তো দূরের কথা পুরস্কৃত হচ্ছে। তিরস্কৃত হচ্ছে ন্যায়-নীতি। আইন বিচারের কামনাকারী নাগরিকরা। খুনি, লুটেরারা সরকারের মদদ, প্রশ্রয় পাচ্ছে। সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে ন্যায়বিচারের আশা তিরোহিত হয়ে গেছে। নাগরিকরা এখন যেন বন্দী জীবন-যাপন করছে। মানুষ দেদারছে খুন হচ্ছে। সরকার তার প্রতিরোধ-প্রতিকার করতে পারছে না। কিংবা প্রতিকার করছে না। মানুষ গুম হচ্ছে, তাকে উদ্ধার অভিযান নিয়ে সরকার কেবলই ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। এখন যে যেখানে খুশি, যাকে খুশি খুন করে, গুম করে ফেলছে। সরকারী বাহিনী এর ব্যতিক্রম নয়।
ফলে গুম এবং খুনের আতঙ্কে গোটা দেশের মানুষ এখন ভীত-সন্ত্রস্ত। পথ চলতে ভয়। এই বুঝি কোথা থেকে কী এক দল সাদা পোশাকধারী নিজেদের আইনশৃক্মখলা বাহিনীর লোক পরিচয় দিয়ে যে কাউকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। নিরাপত্তার জন্য মানুষ ঘরে ফিরে আসে। প্রধানমন্ত্রী সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সরকার কারো বেডরুম পাহারা দিতে পারবে না। নিরাপত্তার জন্য মানুষ গাড়িতে করে ফেরার চেষ্টা করছে। গাড়ি থামিয়ে সাদা পোশাকধারীরা তাদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ এখন মনে করছেন, রাস্তাঘাটে চলাচলের জন্য বাসই নিরাপদ। সেখানে অনেক মানুষের ভেতর থেকে নিশ্চয়ই কেউ তাকে তুলে নিয়ে যেতে পারবে না। গুম করতে পারবে না। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুনের কিনারা তিন মাসেও হয়নি। তদন্তকারী পুলিশ বাহিনী জানিয়েছে, তারা কোনো কিনারা করতে পারেনি। আদালত র‌্যাবকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। প্রায় দুইমাস পর ঐ দম্পতির গলিত লাশ কবর থেকে তুলে এনে ভিসেরা পরীক্ষার নাটক করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ ধরেই নিয়েছে যে, এসবই লোক-দেখানো নাটক। সাগর-রুনি হত্যার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন যে, আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা হবে। গ্রেফতার করা হলো না।
শেষ পর্যন্ত এই হত্যার রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে নিয়েছিলেন। তখনই বোঝা গিয়েছিল যে, সাগর-রুনির কবরের মতো এ হত্যাকান্ডের কিনারা কবরে ঢুকলো। বিএনপি'র সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী গুম হয়ে গেলেন রাত বারোটায় বাড়ি ফেরার পথে। অনেকেই প্রত্যক্ষ করলো যে, আইনশৃক্মখলা বাহিনীর সদস্যরাই তাকে ও তার গাড়ির চালককে জোর করে তুলে নিয়ে গেছে। তারপর ইলিয়াস আলীর আর কোনো খোঁজ নেই। প্রধানমন্ত্রী নিজমুখে ইলিয়াস আলী সম্পর্কে এমন সব কথা বললেন, যাতে গা শিউরে ওঠে। প্রথমে তিনি বললেন, বিরোধীদলীয় নেত্রীর নির্দেশেই ইলিয়াস আলী আত্মগোপন করে আছেন। তারপর বললেন, ইলিয়াস আলীকে তার দলের লোকরাই গুম করেছে। তারপর বললেন, ইলিয়াস আলী এর আগেও আত্মগোপন করেছিলেন। পরে হঠাৎ বেরিয়ে আসেন। শেষমেশ বলেছেন, ইলিয়াস আলী নিজেও এক ভয়ানক সন্ত্রাসী ছিলেন।
একইভাবে তুলে নেয়া হলো বাসের ভেতর থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রকে। বাসভর্তি লোক দেখলেন, র‌্যাবের লোকেরা তাদের বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আজ পর্যন্তও ঐ দুই ছাত্রের কোনো সন্ধান মেলেনি। সবচাইতে আশ্চর্য কান্ড ঘটেছে সরকারের মনোভাবের মধ্য দিয়ে। এই দুই ছাত্র সম্পর্কে এক রিট পিটিশনের সিদ্ধান্তকালে ১৬ মে'র মধ্যে পুলিশ প্রধানকে সশরীরে আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, কেন তার বাহিনী কোনো গুম-অপহরণের ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত করতে পারছে না।
কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই যে, আইজিপিকে এই হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য স্বয়ং অ্যাটর্নি জেনারেল পরদিন ছুটে গেলেন চেম্বার জর্জ আদালতে। গিয়ে তিনি এই হাজিরার আদেশের বিরুদ্ধে আর্জি জানালেন। আর সঙ্গে সঙ্গে চেম্বার জজ ঐ হাজিরা চার সপ্তাহ পিছিয়ে দেয়ার রায় দিলেন। দেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা আদালতের কাছে পুলিশের জবাবদিহিতার বিরুদ্ধে কেন দাঁড়ালেন? অ্যাটর্নি জেনারেল নিজে পুলিশও নন, তদন্তকারীও নন। তাহলে আইজিপিকে ব্যাখ্যা দেবার বাধ্যবাধকতা থেকে রক্ষা কেন করতে হবে? চেম্বার জজ অ্যাটর্নি জেনারেলকে এমনও জানিয়েছেন যে, আইজিপিকে হাজিরা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার আবেদন নিয়ে তিনি যেন সুপ্রীম কোর্টের রেগুলার বেঞ্চে হাজির হন। গা শিউরে ওঠার মতো খবর বৈকি।
এর ফলে দুটো জিনিস প্রায় প্রমাণিতই হয়ে গেল। এসব গুম-অপহরণ ঘটেছে ঘটুক, তার জন্য আইজিপিকে আদালতের সামনে হাজির হওয়ার দরকার নেই। আর অ্যাটর্নি জেনারেলের এই উদ্যোগের ফলে এ অভিযোগও প্রায় প্রমাণিত হয়ে গেল যে, এসব গুম-অপহরণের সঙ্গে সরকারের একটি মহলের যোগসাজশ রয়েছে। তা না হলে এক্ষেত্রে বিচার ও জবাবদিহিতাকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া হতো। এখানে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়তো না। তবে কি এই ভয় ছিল যে, হাইকোর্টের জেরার কোনো ফাঁক দিয়ে পুলিশ প্রধান বলতে বাধ্য হন কিনা যে, সরকারের অমুক মহলের নির্দেশে তদন্তে অগ্রগতি করা সম্ভব হচ্ছে না। অমুক মহলের নির্দেশে তদন্ত কাজ মাঝপথে থামিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ দুই ছাত্রকে যখন আইনশৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনী বাস থামিয়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন বাসের হেলপার তাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন ওদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। এর জবাবে তারা বলেছিল, ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শেষেই এদের ছেড়ে দেয়া হবে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার জানিয়েছে, তাদের অপহরণের সঙ্গে ডিবি পুলিশ এবং র‌্যাব-৪-এর সদস্যরা জড়িত। তারা আসছিল কুষ্টিয়া থেকে বাসে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১টায় নবীনগর থেকে তাদের র‌্যাব পুলিশ নামিয়ে নেয়। যে মাইক্রোবাসে করে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তাতে ৭/৮ জন ছিল। তাদের কারো কারো গায়ে ছিল গোয়েন্দা সংস্থার জ্যাকেট এবং অন্যদের পরনে ছিল র‌্যাবের পোশাক। 
কিন্তু এই দু'মাসেও তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। তাদের পরিবারের সদস্যরা আইনশৃক্মখলা বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করেছে। তাতেও কোনো সুরাহা হয়নি। তারা এখনও নিখোঁজ। অধিকার জানিয়েছে, ডিবি কর্মকর্তা ওয়াহেদুর জামান অধিকারকে বলেছে, ঐদিন নবীনগর এলাকায় ঐ বাহিনী কোনো তল্লাশী চালায়নি। এদিকে র‌্যাব কর্মকর্তা লে. কর্নেল আবদুল্লাহ ইবনে জায়িদ এ সম্পর্কে অধিকারের কাছে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন।
ঐ ছাত্রের একজনের বাড়ি পিরোজপুর। অপরজনের বাড়ি ঝালকাঠি। একজন ঢাকায় এসেছিল একটি মিউজিক অ্যালবাম তৈরি করার জন্য। অপরজন এসেছিল কিছু জিনিস ছাপিয়ে নেয়ার জন্য। হাইকোর্ট একটি রিট আবেদনের জবাবে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র সচিব, র‌্যাব ডিজিসহ মোট নয়জনের ওপর তিন সপ্তাহের মধ্যে অপহৃত ঐ দুই ছাত্রকে আদালতের সামনে হাজির করতে বলে। তিন সপ্তাহ পর আদালতে হাজির হয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান যে, নিখোঁজ দুই ছাত্রের কোনো খোঁজ তারা জানেননি। এতে আদালত সন্তুষ্ট হতে পারেননি। আদালত নির্দেশ দেন যে, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এই অপহরণের তদন্তের বিষয়টি তারা যেন আদালতকে জানান। এক সপ্তাহ পর তারা আদালতে হাজির হন এবং কোনো তথ্য দিতে ব্যর্থ হন। এই প্রেক্ষিতেই ১৬ মার্চ সশরীরে হাজির হয়ে আইজিপিকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দেন আদালত। এবং ব্যাখ্যা করতে বলেন যে, বাদীর দাবি অনুযায়ী তারা র‌্যাব ক্যাম্পে আটক আছে, সেখান থেকে তাদের কেন উদ্ধার করা হয়নি। এমনকি তদন্ত কর্মকর্তা তাদের মোবাইল কললিস্ট পরীক্ষা করে জানাতেও পারেননি যে, অপহরণের আগে কার কার সঙ্গে তাদের কথা হয়েছিল।
এদিকে গত সপ্তাহে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে অভিযোগ করেছেন যে, তার স্বামীকে উদ্ধার করার জন্য আইনশৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর থেকে এ পর্যন্ত পুলিশ তাকে আর কিছু জানায়ওনি। এতে তিনি খুবই অসহায় বোধ করছেন। এদিকে বিএনপি প্রথম থেকেই অভিযোগ করছিল যে, ইলিয়াস আলীকে সরকারই গুম করেছে এবং তাকে ফেরত দেয়া হোক।
এদিকে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ দুই ছাত্র এবং বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর অপহরণের ঘটনার মধ্যে সাযুজ্য রয়েছে। অপহরণকারীরা একই ধরনের মাইক্রোবাসে করে অপহরণ করেছে। এবং অপহরণকারীদের পরনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পোশাক ছিল। আরও যারা অপহৃত হয়েছেন তাদের আত্মীয়স্বজনও বরাবরই অভিযোগ করে আসছেন, অপহরণকারীদের পরনে আইনশৃক্মখলা বাহিনীর পোশাক ছিল। কিন্তু ডিবি বা র‌্যাব বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। শেষ পর্যন্ত আদালতের কাছে প্রকৃত ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে আইজিপিকে আদালতে হাজির হওয়ার বিরুদ্ধে অ্যাটর্নি জেনারেলকে দাঁড়াতে হয়েছে। এ কেমন অচেনা স্বদেশ! এ কেমন অচেনা শাসন!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন