॥ ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ॥
এখন আমরা যে যার যেমন খুশি, তাই বলছি। যে যার যেমন খুশি, তাই করছি। এই যেমন খুশির কাতার থেকে ব্যক্তি, আইন, প্রশাসন, বিচার কেউই বাদ পড়ছে না। বিগত ৪১ বছরে বাংলাদেশ সম্ভবত এত বিপন্ন কখনো হয়নি। এ রাষ্ট্রে অর্থনীতি গেছে, কূটনীতি গেছে, মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার গেছে, যে কেউ যখন যাকে খুশি গুম-খুন-ধর্ষণ-নির্যাতন করতে পারছে। বিচার হলো এই যে, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামিরা সরকারের প্রকাশ্য মায় বুক ফুলিয়ে জেল থেকে বের হয়ে আসছে। মন্ত্রীরা সার্কিট হাউজে ডেকে তাদের ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনা জানাচ্ছেন। মাদক নিয়ে এখন আর রাষ্ট্রের কেউ চিন্তিত নয়। প্রশাসনের কেউ চিন্তিত নয়। মাঝেমধ্যে দেখা যায়, হাজার হাজার বোতল আটককৃত ফেনসিডিল পুলিশ বুলডোজার দিয়ে ডলে ভেঙে দিচ্ছে। কিন্তু তা এ দেশে আসার পথ রুদ্ধ করার কোনো পদপে কেউ নিচ্ছে না। অস্ত্র আসছে। মাদক আসছে। আমদানিকৃত পণ্যের বদলে দুই নম্বরি বিলাসসামগ্রী আসছে। সরকার কেবলই চুপচাপ দেখে যাচ্ছে। কিংবা একে উৎসাহিত করছে।
বুদ্ধিজীবী তথা সুশীল সমাজের কেউ কেউ পত্রপত্রিকায় লিখে কেবল প্যানডোরার বাক্সের শেষ দুর্বল মৌমাছিটির মতো আশার আলো জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আজ আশা নেই, ভালোবাসা নেই। কেউ কেউ স্যাটেলাইট টেলিভিশনে গিয়ে দু’চার কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। তাদের সবাই এখন প্রায় চ্যানেলে নিষিদ্ধ হতে বসেছেন। সরকার অমুক লোকদের আনতে হবে বলে যে আদেশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, তার বাইরে মুক্ত চিন্তার বুদ্ধিজীবীদের টিভিতে আগমন বিরল ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এখন স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল সংবাদপত্রের মতোই শক্তিশালী। কারণ গ্রামগঞ্জেও ডিস লাইন আছে। এবং নিরর সাধারণ মানুষও গভীর রাত পর্যন্ত ডিস লাইনের পাশে বসে থাকে। সেটিও বড় বেশি নিয়ন্ত্রিত।
সরকার আইন করেছে, কোন দেশের সাথে, কার সাথে তারা কী চুক্তি করবে, এটি প্রধানমন্ত্রী ছাড়া এ দেশের নাগরিকদের জানার অধিকার নেই। সে অধিকার আইন করে রহিত করা হয়েছে। যে সংসদ সদস্যরা হ্যাঁ বলে রায় দিয়েছেন, তারা কি ভেবে দেখেছিলেন যে, এর মাধ্যমে তার দেশ তার নির্বাচনী এলাকায় তার সার্বভৌমত্ব মারাত্মকভাবে ুণœ হতে পারে। সম্ভবত সেটি বিবেচনা করার কথা তারা চিন্তাও করেননি। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে তারা কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন। সংসদে একটা ইস্যুতেই কেবল তারা মুখ তুলতে সাহস করেছেন যে, বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ দিতে হবে। এর বাইরে রাষ্ট্র যে যায়, এমন সব আইন তারা শুধু ‘হ্যাঁ’ বলে পাস করে দিয়েছেন। সংসদ সদস্যরা এরকম ‘হ্যাঁ’ বলায় ভারত তিতাস নদীর ওপর দিয়ে একেবারে নদী বন্ধ করে পাকা রাস্তা নির্মাণ করেছিল, তাদের শত শত টন ওজনের ট্রেইলার পার করার জন্য। সেটা প্রায় মাস ছয়েক চালু ছিল। নদী হত্যা করা হচ্ছে। মানুষের জীবন-জীবিকা, পানির প্রবাহ সব বন্ধ হয়ে গেছে। যে নৌকা সরাসরি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেত পণ্য নিয়ে, তারা আর যেতে পারেনি। সরকার আশ্চর্য কথা বলল। বলল, তারা জানে না কারা এই নদীর ওপর বাঁধ দিয়েছে। মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ, আপনারা কি জানেন কারা বাঁধ দিয়েছিল? গোটা এলাকার লাখ লাখ মানুষ জীবন-জীবিকায় বিপন্ন হয়ে পড়েছিল? সম্ভবত মহাজোটের কোনো সংসদ সদস্যই এর জবাব দিতে পারবেন না। দিতে পারলে অনেক আগেই তারা মুখ খুলতেন।
তার অর্থ হলো, যেকোনো কারণেই হোক সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টার ও সংসদ সদস্যরা বোধ করি ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছেন। তাদের কিছুই করার নেই। বলার নেই। ১৯৭২-৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালে দ্রুত পণ্য চাহিদা মেটাতে ওজিএল বলে এক লাইসেন্স প্রথা চালু করা হয়েছিল। তার নাম ওপেন জেনারেল লাইসেন্স। এখন বাংলাদেশে সবকিছু ওপেন জেনারেল লাইসেন্স, যার যা খুশি, তাই বলে যেতে পারছেন। এর জন্য কোনো জবাবদিহিতা নেই কিংবা জবাবদিহিতার প্রয়োজনও নেই। সবকিছু ওপেন জেনারেল লাইসেন্স। খুন করতে চাও করো। নিজে করলেও তি নেই। না হলে হাজার পঞ্চাশেক টাকা জোগাড় করে একজন ভাড়াটে খুনির ব্যবস্থা করো। যে কাউকে খুন করো। কোনো অসুবিধা নেই।
সরকারও বলতে গেলে সে ভূমিকায়ই অবতীর্ণ হয়েছে। সব মহল থেকে অভিযোগ উঠছে, র্যাব-পুলিশ পরিচয়ে কাউকে কাউকে তুলে নেয়া হচ্ছে। তারপর তাদের আর হদিস মিলছে না। এটা শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। স্কুলছাত্র, কলেজছাত্র, রাজনৈতিক নেতাÑ সবাই নির্বিঘেœ গুম হয়ে যাচ্ছে। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আদালত নির্দেশ দিচ্ছেন তাদের সন্ধান দাও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সন্ধান তো করতে পারছি না, কী করব? এ রকমই চলছে সবকিছু। প্রতি েেত্রই সন্দেহ হচ্ছে, এসব গুম, খুন, সন্ত্রাসের সাথে সরকার জড়িত। তারা যে পারছে না, তা নিয়ে সরকারে যেহেতু কোনো মাথাব্যথা নেই, ফলে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, সরকার সত্যি সত্যি জড়িত।
আমরা সাধারণ নাগরিকেরা প্রতি পদে পদে ভয়ের সাথে চলি। ভীত হয়ে থাকি। এই যে বাসায় রওনা হলাম, বাসে কিংবা গাড়িতে। ফিরতে পারব তো? বাসে যদি যাই, তাহলে মনে হয়, বাস থামিয়ে কেউ একদিন বাসের ভেতরে জিজ্ঞেস করবে যে, এই বাসে রেজোয়ান সিদ্দিকী বলে কোনো যাত্রী আছে কি? খুব স্বাভাবিক যে, সৎ মানুষ হিসেবে আমি সাড়া দেবো। তারপর হারিয়ে যাবো। কেউ আর কোনো দিন আমার সন্ধান পাবে না। গাড়িতে যদি যাই, ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনার পর ড্রাইভারকে বলে রেখেছি, কেউ যদি পেছন থেকে গাড়িতে আঘাত করে তাহলে ট্রাফিক সিগন্যাল-টিগন্যাল ভঙ্গ করে যেভাবে পারো দ্রুত সে এলাকা ত্যাগ করে যেখানে মানুষ বেশি সেখানে থামাবে। ড্রাইভার বলল, স্যার, থানার কাছে গিয়ে থামাব? আমি বললাম, কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ থানা এখন আর কোনো ভরসার স্থল নয়। জনগণই ভরসাস্থল। মহান আল্লাহ তায়ালার অপরিসীম রহমতে এখন পর্যন্ত বাসে বা গাড়িতে তেমন বিপদে পড়িনি।
কিন্তু আমি বিপদে পড়িনি, এ দেশে শত শত মানুষ এভাবে বিপদে পড়ে গুম হয়ে গেছে। তাদের পরিবারের আর্তকান্না সরকারের হৃদয় স্পর্শ করেনি। এখন সম্ভবত দেশে কোনো সরকার নেই। ঘাতক আছে। লুটেরা আছে। সরকারের মদদে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটের বন্দোবস্ত আছে। এবং সংসদে মাননীয় সদস্যরা ‘হ্যাঁ’ বলে এমন এক বিধান পাস করেছেন যে, বিদ্যুৎ বিষয়ে কোনো যুক্তি বা কোনো বিষয়ে কোনো আদালতে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ আপনারা এমন আইন পাস করেছেন বটে, কিন্তু আপনারা সম্ভবত এই ধারণা করেন যে, শেখ হাসিনা যাই করুন না কেন আপনার রাজনৈতিক পরিণতি এবং এলাকার জনগণের সাথে আপনাদের থাকতে হবে এবং এ দেশেই থাকতে হবে। এমনকি শেখ হাসিনা যদি নাও থাকেন, তাহলে আপনাদের জনগণের সাথে থাকতেই হবে। বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কেউ নেই। তার ছেলে মার্কিন নাগরিক। মেয়ে কানাডিয়ান। বোন ব্রিটিশ। তাদের নাতিনাতকুরেরা বিদেশিনীদেরই বিয়ে করছেন। ফলে শেখ হাসিনার এ দেশে কী আছে? কার্যত টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবের মাজার। আর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়ি। এ ছাড়া বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আর কিছুই নেই। এবং তিনি সুযোগ পেলেই যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। হয়তো সেখানেই অভিবাসী হবেন।
কিন্তু তার শাসনকাল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মসীলিপ্ত এক অধ্যায়। চতুর্দিকে শুধুই ধ্বংসযজ্ঞ। শুধুই সর্বনাশের খেলা। সবচেয়ে বড় তি রাষ্ট্রের তিনি যা করেছেন তা হলোÑ এই সমাজ সংস্কৃতির কাঠামো তিনি যেন একেবারে ভেঙে দিয়েছেন। হাজার হাজার বছর ধরে এখানে যে সমাজ কাঠামো গড়ে উঠেছিল, যে মূল্যবোধ গড়ে উঠেছিল, এখানকার আবহাওয়া, প্রকৃতি, পরিবেশ, এ দেশের মানুষের জীবনাচরণ নির্দিষ্ট করেছিল। তার ফলে প্রায় দুই হাজার বছরের অবিরাম প্রচেষ্টায় যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল তাকে তিনি একেবারে তছনছ করে ফেলেছেন। এ যে কী বিশাল সুদূরপ্রসারী ধ্বংসকারী প্রভাব এই সমাজের ওপর পড়বে, সেটা বোঝার মতা সম্ভবত তারও নেই এবং তার পরামর্শকদেরও কারো নেই। আর যদি থাকেও, তাহলে ইচ্ছাকৃতভাবে এ দেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে তিনি উঠেপড়ে লেগেছেন। যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য একটি জাতিসত্তা গঠন করে এবং সে জাতিসত্তায় স্বাধীনতার আগ্রহ প্রবল করে। তারই জের ধরে এ দেশে যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে এই ভূখণ্ডের মানুষ নিজেদের বসবাসের জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেছে। গোটা দণি এশিয়ায় কোনো দেশই যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। সবাই স্বাধীনতা অর্জন করেছে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। ঔপনিবেশিক শাসকদের সাথে আলোচনা করেই কখনো কখনো ঔপনিবেশিক শাসকেরা তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই এসব দেশ ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন। সে েেত্র দণি এশিয়ায় বাংলাদেশ ও তার মানুষ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
এই যুদ্ধকে গৌরবান্বিত করার জন্য জিয়াউর রহমান প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। দেশ ও দেশের মানুষকে তিনি গৌরবময় মর্যাদা দেয়ার জন্য একদিকে রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন মাইলফলক নির্মাণ করেছিলেন, তেমনি এ দেশের জনগণের মুক্তির জন্য তার নীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। সেখানেই জিয়া অনন্যসাধারণ। তার নীতি যদি এ দেশে পরবর্তী শাসনকালে সঠিকভাবে অনুসৃত হতো, তাহলে বাংলাদেশ এখন ধারণা করি মালয়েশিয়ার চেয়েও অনেক ওপরে থাকত।
শেখ হাসিনার সরকার সে পথ পরিহার করেছেন। সেই সাথে এ দেশের ইতিহাস থেকে জিয়াউর রহমানের নাম একেবারে বোধ করি মুছে দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শেখ হাসিনাকে কে বোঝাবে যে, এভাবে কারো কৃতি বা কীর্তি কিছুই মুছে ফেলা যায় না। ইতিহাস আপন গতিধারায় চলতে থাকে।
যে ইসলাম এই রাষ্ট্রের ভিত্তি, সেই ইসলামকে একেবারে মুছে ফেলার জন্য শেখ হাসিনার প্রচেষ্টার অন্ত নেই। সংবিধানে বিসমিল্লাহ এখনো অব্যাহত আছে বটে, কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালার নামে যা কিছু করার বিধান সংবিধানে ছিল, তার সবই ইতোমধ্যেই মুছে ফেলা হয়েছে। প্রশাসনের সর্বত্রই বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের প্রবল প্রতাপ, যারা মুসলমান নয়। নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে শেখ হাসিনার সরকারের বিবেচনায় এখন মুসলমান তার যোগ্যতা সম্পূর্ণই হারিয়েছে। প্রশাসনের চেহারা দেখলে মনে হয়, মুসলমানদের ফের এ দেশে অচ্ছুৎ করে তোলা হয়েছে। মুসলমানের দেশে মুসলমানরাই এখন যেন নিজ ভূমে পরবাসীতে পরিণত হচ্ছে। শিাব্যবস্থা থেকে ধর্মের নিশানা উধাও করা হয়েছে। এমনকি মাদ্রাসা শিাব্যবস্থায়ও আলেম তৈরির পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। দেশে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে দেশ সম্পূর্ণরূপে ভারতনির্ভর হয়ে পড়ে। একদিকে ধর্মের অস্তিত্ব বিলোপ, সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব বিলোপ, অন্যদিকে ভারতের সীমাহীন আগ্রাসন। দেশকে, দেশের ভবিষ্যতকে সীমাহীন অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে।
নতুন প্রজন্ম যেমন শিাদীায় পিছিয়ে পড়ছে, জ্ঞান-গবেষণায় পিছিয়ে পড়ছে, তেমনি তাদেরকে ধর্মীয় বোধগুলো থেকে কেবলই বিচ্ছিন্ন করে তোলা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রচেষ্টার বিপরীত চিত্রও সমাজে একেবারে অনুপস্থিত নয়। চোখ-কান খোলা রাখলে শেখ হাসিনা নিজেও তা দেখতে পেতেন, এটুকুই আশার কথা।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
এখন আমরা যে যার যেমন খুশি, তাই বলছি। যে যার যেমন খুশি, তাই করছি। এই যেমন খুশির কাতার থেকে ব্যক্তি, আইন, প্রশাসন, বিচার কেউই বাদ পড়ছে না। বিগত ৪১ বছরে বাংলাদেশ সম্ভবত এত বিপন্ন কখনো হয়নি। এ রাষ্ট্রে অর্থনীতি গেছে, কূটনীতি গেছে, মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার গেছে, যে কেউ যখন যাকে খুশি গুম-খুন-ধর্ষণ-নির্যাতন করতে পারছে। বিচার হলো এই যে, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামিরা সরকারের প্রকাশ্য মায় বুক ফুলিয়ে জেল থেকে বের হয়ে আসছে। মন্ত্রীরা সার্কিট হাউজে ডেকে তাদের ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনা জানাচ্ছেন। মাদক নিয়ে এখন আর রাষ্ট্রের কেউ চিন্তিত নয়। প্রশাসনের কেউ চিন্তিত নয়। মাঝেমধ্যে দেখা যায়, হাজার হাজার বোতল আটককৃত ফেনসিডিল পুলিশ বুলডোজার দিয়ে ডলে ভেঙে দিচ্ছে। কিন্তু তা এ দেশে আসার পথ রুদ্ধ করার কোনো পদপে কেউ নিচ্ছে না। অস্ত্র আসছে। মাদক আসছে। আমদানিকৃত পণ্যের বদলে দুই নম্বরি বিলাসসামগ্রী আসছে। সরকার কেবলই চুপচাপ দেখে যাচ্ছে। কিংবা একে উৎসাহিত করছে।
বুদ্ধিজীবী তথা সুশীল সমাজের কেউ কেউ পত্রপত্রিকায় লিখে কেবল প্যানডোরার বাক্সের শেষ দুর্বল মৌমাছিটির মতো আশার আলো জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আজ আশা নেই, ভালোবাসা নেই। কেউ কেউ স্যাটেলাইট টেলিভিশনে গিয়ে দু’চার কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। তাদের সবাই এখন প্রায় চ্যানেলে নিষিদ্ধ হতে বসেছেন। সরকার অমুক লোকদের আনতে হবে বলে যে আদেশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, তার বাইরে মুক্ত চিন্তার বুদ্ধিজীবীদের টিভিতে আগমন বিরল ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এখন স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল সংবাদপত্রের মতোই শক্তিশালী। কারণ গ্রামগঞ্জেও ডিস লাইন আছে। এবং নিরর সাধারণ মানুষও গভীর রাত পর্যন্ত ডিস লাইনের পাশে বসে থাকে। সেটিও বড় বেশি নিয়ন্ত্রিত।
সরকার আইন করেছে, কোন দেশের সাথে, কার সাথে তারা কী চুক্তি করবে, এটি প্রধানমন্ত্রী ছাড়া এ দেশের নাগরিকদের জানার অধিকার নেই। সে অধিকার আইন করে রহিত করা হয়েছে। যে সংসদ সদস্যরা হ্যাঁ বলে রায় দিয়েছেন, তারা কি ভেবে দেখেছিলেন যে, এর মাধ্যমে তার দেশ তার নির্বাচনী এলাকায় তার সার্বভৌমত্ব মারাত্মকভাবে ুণœ হতে পারে। সম্ভবত সেটি বিবেচনা করার কথা তারা চিন্তাও করেননি। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে তারা কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন। সংসদে একটা ইস্যুতেই কেবল তারা মুখ তুলতে সাহস করেছেন যে, বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ দিতে হবে। এর বাইরে রাষ্ট্র যে যায়, এমন সব আইন তারা শুধু ‘হ্যাঁ’ বলে পাস করে দিয়েছেন। সংসদ সদস্যরা এরকম ‘হ্যাঁ’ বলায় ভারত তিতাস নদীর ওপর দিয়ে একেবারে নদী বন্ধ করে পাকা রাস্তা নির্মাণ করেছিল, তাদের শত শত টন ওজনের ট্রেইলার পার করার জন্য। সেটা প্রায় মাস ছয়েক চালু ছিল। নদী হত্যা করা হচ্ছে। মানুষের জীবন-জীবিকা, পানির প্রবাহ সব বন্ধ হয়ে গেছে। যে নৌকা সরাসরি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেত পণ্য নিয়ে, তারা আর যেতে পারেনি। সরকার আশ্চর্য কথা বলল। বলল, তারা জানে না কারা এই নদীর ওপর বাঁধ দিয়েছে। মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ, আপনারা কি জানেন কারা বাঁধ দিয়েছিল? গোটা এলাকার লাখ লাখ মানুষ জীবন-জীবিকায় বিপন্ন হয়ে পড়েছিল? সম্ভবত মহাজোটের কোনো সংসদ সদস্যই এর জবাব দিতে পারবেন না। দিতে পারলে অনেক আগেই তারা মুখ খুলতেন।
তার অর্থ হলো, যেকোনো কারণেই হোক সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টার ও সংসদ সদস্যরা বোধ করি ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছেন। তাদের কিছুই করার নেই। বলার নেই। ১৯৭২-৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালে দ্রুত পণ্য চাহিদা মেটাতে ওজিএল বলে এক লাইসেন্স প্রথা চালু করা হয়েছিল। তার নাম ওপেন জেনারেল লাইসেন্স। এখন বাংলাদেশে সবকিছু ওপেন জেনারেল লাইসেন্স, যার যা খুশি, তাই বলে যেতে পারছেন। এর জন্য কোনো জবাবদিহিতা নেই কিংবা জবাবদিহিতার প্রয়োজনও নেই। সবকিছু ওপেন জেনারেল লাইসেন্স। খুন করতে চাও করো। নিজে করলেও তি নেই। না হলে হাজার পঞ্চাশেক টাকা জোগাড় করে একজন ভাড়াটে খুনির ব্যবস্থা করো। যে কাউকে খুন করো। কোনো অসুবিধা নেই।
সরকারও বলতে গেলে সে ভূমিকায়ই অবতীর্ণ হয়েছে। সব মহল থেকে অভিযোগ উঠছে, র্যাব-পুলিশ পরিচয়ে কাউকে কাউকে তুলে নেয়া হচ্ছে। তারপর তাদের আর হদিস মিলছে না। এটা শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। স্কুলছাত্র, কলেজছাত্র, রাজনৈতিক নেতাÑ সবাই নির্বিঘেœ গুম হয়ে যাচ্ছে। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আদালত নির্দেশ দিচ্ছেন তাদের সন্ধান দাও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সন্ধান তো করতে পারছি না, কী করব? এ রকমই চলছে সবকিছু। প্রতি েেত্রই সন্দেহ হচ্ছে, এসব গুম, খুন, সন্ত্রাসের সাথে সরকার জড়িত। তারা যে পারছে না, তা নিয়ে সরকারে যেহেতু কোনো মাথাব্যথা নেই, ফলে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, সরকার সত্যি সত্যি জড়িত।
আমরা সাধারণ নাগরিকেরা প্রতি পদে পদে ভয়ের সাথে চলি। ভীত হয়ে থাকি। এই যে বাসায় রওনা হলাম, বাসে কিংবা গাড়িতে। ফিরতে পারব তো? বাসে যদি যাই, তাহলে মনে হয়, বাস থামিয়ে কেউ একদিন বাসের ভেতরে জিজ্ঞেস করবে যে, এই বাসে রেজোয়ান সিদ্দিকী বলে কোনো যাত্রী আছে কি? খুব স্বাভাবিক যে, সৎ মানুষ হিসেবে আমি সাড়া দেবো। তারপর হারিয়ে যাবো। কেউ আর কোনো দিন আমার সন্ধান পাবে না। গাড়িতে যদি যাই, ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনার পর ড্রাইভারকে বলে রেখেছি, কেউ যদি পেছন থেকে গাড়িতে আঘাত করে তাহলে ট্রাফিক সিগন্যাল-টিগন্যাল ভঙ্গ করে যেভাবে পারো দ্রুত সে এলাকা ত্যাগ করে যেখানে মানুষ বেশি সেখানে থামাবে। ড্রাইভার বলল, স্যার, থানার কাছে গিয়ে থামাব? আমি বললাম, কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ থানা এখন আর কোনো ভরসার স্থল নয়। জনগণই ভরসাস্থল। মহান আল্লাহ তায়ালার অপরিসীম রহমতে এখন পর্যন্ত বাসে বা গাড়িতে তেমন বিপদে পড়িনি।
কিন্তু আমি বিপদে পড়িনি, এ দেশে শত শত মানুষ এভাবে বিপদে পড়ে গুম হয়ে গেছে। তাদের পরিবারের আর্তকান্না সরকারের হৃদয় স্পর্শ করেনি। এখন সম্ভবত দেশে কোনো সরকার নেই। ঘাতক আছে। লুটেরা আছে। সরকারের মদদে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটের বন্দোবস্ত আছে। এবং সংসদে মাননীয় সদস্যরা ‘হ্যাঁ’ বলে এমন এক বিধান পাস করেছেন যে, বিদ্যুৎ বিষয়ে কোনো যুক্তি বা কোনো বিষয়ে কোনো আদালতে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ আপনারা এমন আইন পাস করেছেন বটে, কিন্তু আপনারা সম্ভবত এই ধারণা করেন যে, শেখ হাসিনা যাই করুন না কেন আপনার রাজনৈতিক পরিণতি এবং এলাকার জনগণের সাথে আপনাদের থাকতে হবে এবং এ দেশেই থাকতে হবে। এমনকি শেখ হাসিনা যদি নাও থাকেন, তাহলে আপনাদের জনগণের সাথে থাকতেই হবে। বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কেউ নেই। তার ছেলে মার্কিন নাগরিক। মেয়ে কানাডিয়ান। বোন ব্রিটিশ। তাদের নাতিনাতকুরেরা বিদেশিনীদেরই বিয়ে করছেন। ফলে শেখ হাসিনার এ দেশে কী আছে? কার্যত টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবের মাজার। আর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়ি। এ ছাড়া বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আর কিছুই নেই। এবং তিনি সুযোগ পেলেই যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। হয়তো সেখানেই অভিবাসী হবেন।
কিন্তু তার শাসনকাল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মসীলিপ্ত এক অধ্যায়। চতুর্দিকে শুধুই ধ্বংসযজ্ঞ। শুধুই সর্বনাশের খেলা। সবচেয়ে বড় তি রাষ্ট্রের তিনি যা করেছেন তা হলোÑ এই সমাজ সংস্কৃতির কাঠামো তিনি যেন একেবারে ভেঙে দিয়েছেন। হাজার হাজার বছর ধরে এখানে যে সমাজ কাঠামো গড়ে উঠেছিল, যে মূল্যবোধ গড়ে উঠেছিল, এখানকার আবহাওয়া, প্রকৃতি, পরিবেশ, এ দেশের মানুষের জীবনাচরণ নির্দিষ্ট করেছিল। তার ফলে প্রায় দুই হাজার বছরের অবিরাম প্রচেষ্টায় যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল তাকে তিনি একেবারে তছনছ করে ফেলেছেন। এ যে কী বিশাল সুদূরপ্রসারী ধ্বংসকারী প্রভাব এই সমাজের ওপর পড়বে, সেটা বোঝার মতা সম্ভবত তারও নেই এবং তার পরামর্শকদেরও কারো নেই। আর যদি থাকেও, তাহলে ইচ্ছাকৃতভাবে এ দেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে তিনি উঠেপড়ে লেগেছেন। যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য একটি জাতিসত্তা গঠন করে এবং সে জাতিসত্তায় স্বাধীনতার আগ্রহ প্রবল করে। তারই জের ধরে এ দেশে যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে এই ভূখণ্ডের মানুষ নিজেদের বসবাসের জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেছে। গোটা দণি এশিয়ায় কোনো দেশই যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। সবাই স্বাধীনতা অর্জন করেছে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। ঔপনিবেশিক শাসকদের সাথে আলোচনা করেই কখনো কখনো ঔপনিবেশিক শাসকেরা তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই এসব দেশ ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন। সে েেত্র দণি এশিয়ায় বাংলাদেশ ও তার মানুষ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
এই যুদ্ধকে গৌরবান্বিত করার জন্য জিয়াউর রহমান প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। দেশ ও দেশের মানুষকে তিনি গৌরবময় মর্যাদা দেয়ার জন্য একদিকে রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন মাইলফলক নির্মাণ করেছিলেন, তেমনি এ দেশের জনগণের মুক্তির জন্য তার নীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। সেখানেই জিয়া অনন্যসাধারণ। তার নীতি যদি এ দেশে পরবর্তী শাসনকালে সঠিকভাবে অনুসৃত হতো, তাহলে বাংলাদেশ এখন ধারণা করি মালয়েশিয়ার চেয়েও অনেক ওপরে থাকত।
শেখ হাসিনার সরকার সে পথ পরিহার করেছেন। সেই সাথে এ দেশের ইতিহাস থেকে জিয়াউর রহমানের নাম একেবারে বোধ করি মুছে দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শেখ হাসিনাকে কে বোঝাবে যে, এভাবে কারো কৃতি বা কীর্তি কিছুই মুছে ফেলা যায় না। ইতিহাস আপন গতিধারায় চলতে থাকে।
যে ইসলাম এই রাষ্ট্রের ভিত্তি, সেই ইসলামকে একেবারে মুছে ফেলার জন্য শেখ হাসিনার প্রচেষ্টার অন্ত নেই। সংবিধানে বিসমিল্লাহ এখনো অব্যাহত আছে বটে, কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালার নামে যা কিছু করার বিধান সংবিধানে ছিল, তার সবই ইতোমধ্যেই মুছে ফেলা হয়েছে। প্রশাসনের সর্বত্রই বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের প্রবল প্রতাপ, যারা মুসলমান নয়। নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে শেখ হাসিনার সরকারের বিবেচনায় এখন মুসলমান তার যোগ্যতা সম্পূর্ণই হারিয়েছে। প্রশাসনের চেহারা দেখলে মনে হয়, মুসলমানদের ফের এ দেশে অচ্ছুৎ করে তোলা হয়েছে। মুসলমানের দেশে মুসলমানরাই এখন যেন নিজ ভূমে পরবাসীতে পরিণত হচ্ছে। শিাব্যবস্থা থেকে ধর্মের নিশানা উধাও করা হয়েছে। এমনকি মাদ্রাসা শিাব্যবস্থায়ও আলেম তৈরির পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। দেশে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে দেশ সম্পূর্ণরূপে ভারতনির্ভর হয়ে পড়ে। একদিকে ধর্মের অস্তিত্ব বিলোপ, সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব বিলোপ, অন্যদিকে ভারতের সীমাহীন আগ্রাসন। দেশকে, দেশের ভবিষ্যতকে সীমাহীন অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে।
নতুন প্রজন্ম যেমন শিাদীায় পিছিয়ে পড়ছে, জ্ঞান-গবেষণায় পিছিয়ে পড়ছে, তেমনি তাদেরকে ধর্মীয় বোধগুলো থেকে কেবলই বিচ্ছিন্ন করে তোলা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রচেষ্টার বিপরীত চিত্রও সমাজে একেবারে অনুপস্থিত নয়। চোখ-কান খোলা রাখলে শেখ হাসিনা নিজেও তা দেখতে পেতেন, এটুকুই আশার কথা।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com