শনিবার, ২ জুন, ২০১২

একে কি সরকার বলে?

একে কি সরকার বলে?



॥ ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ॥

এখন যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন, তাদের যে কী বলে অভিহিত করব, ভেবে পাই না। যদি বলি এটা মাস্তানের সরকার কিংবা সন্ত্রাসীর সরকার, তাহলে ভয়ের কারণ আছে। আদালতও আমাকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জিজ্ঞেস করতে পারেনÑ তুমি কি বিবেচনায় এই সরকারকে সন্ত্রাসী বা মাস্তানদের সরকার বলছ? কী যে জবাব দেবো বুঝে উঠতে পারি না। কিংবা সে জবাব আদালতের মনঃপূত হবে কি না তা-ও নিশ্চিত নই। কিংবা সরকার যা বলছে, তা যদি বাস্তবায়ন হয়! হয়তো হবেই, তাহলে আমার লাশও হয়তো পাওয়া যাবে না। এখন এই রকমই ভয় হয়।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু সম্প্রতি সাংবাদিকদের এ মর্মে পরামর্শ দিয়েছেন যে, তারা যেন পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকে সংবাদ সংগ্রহ করেন। অর্থাৎ ‘পুলিশ হইতে সাবধান’। ১৯৬৯ সালে আমি ঢাকায় এসেছি। তখন ঢাকার বিভিন্ন বাড়িতে সাইনবোর্ড দেখেছি, ‘কুকুর হইতে সাবধান’। কারণ সম্ভবত ওই সব বাড়ির মালিকদের পোষা কুকুর ছিল, যারা অপরিচিত লোকদের দেখলেই আক্রমণ করে বসত। এখন সেসব সাইনবোর্ড খুব একটা দেখি না। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার একচল্লিশ বছরের মাথায় দেশের এক মন্ত্রীর মুখে শুনলাম, ‘পুলিশ হইতে সাবধান’।
শৈশব থেকে শুনে এসেছি পুলিশ জনগণের বন্ধু। আমি আমার ছেলেমেয়েদের শিা দেয়ার চেষ্টা করেছি, যেকোনো বিপদে পড়লে দ্রুত পুলিশের সহায়তা নেবে। পুলিশ এখন ভয়ঙ্কর। পুলিশের যে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বা জনগণকে বলতে পারেনÑ পুলিশ থেকে সাবধান, তার শিা, রুচি, যোগ্যতা ও জনসম্পৃক্ততা প্রশ্নবিদ্ধ হতে তো বাধ্য। কিন্তু এর পরপরই অবিবাহিত, সুকণ্ঠী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলে বসলেন, পুলিশ এখন সবচেয়ে ভালো। এই পুলিশ এখন কলগার্ল নিয়ে মৌজ করছে, মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করছে, সরকারের নির্দেশে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে হয়রানি করছে, আদালত প্রাঙ্গণ থেকে কিশোরীকে তুলে নিয়ে তার শ্লীলতাহানি ঘটাচ্ছে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, এখন থেকে পুলিশের গাড়িতে ‘পুলিশ’ লিখে রাখার আর কোনো প্রয়োজন নেই।
এই নিঃসন্তান-অবিবাহিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বুঝতে পারার কোনো কারণ নেইÑ সন্তান হারালে একজন মায়ের কী কষ্ট হয় অথবা একজন বাবাকে কতটুকু বেদনার বোঝা বইতে হয় কিংবা একটা সংসারে কী ভীষণ শোকের ছায়া নামে। ফলে অবলীলায় তিনি পুলিশের পে যখন সাফাই গাইতে থাকেন, তখন পুলিশ যে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে তাতে অস্বাভাবিকতার কী আছে? পুলিশ কিংবা র‌্যাব পরিচয়ে এখন তুলে নেয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। তারপর মুক্তিপণের দাবি করা হচ্ছে। মুক্তিপণের অর্থ না দিতে পারলে সে গুম হয়ে যাচ্ছে কিংবা তার লাশ পাওয়া যাচ্ছে এদিক-ওদিক।
তা হলে সমাজের ভিতর কী হচ্ছে? পুলিশ কিংবা র‌্যাব পরিচয়ে কোনো সন্ত্রাসী বাহিনী যেকোনো সময় যেকোনো লোককে তুলে নিয়ে যাবে। হয়তো এ প্রশ্ন আসবে যে, সে কেন পুলিশ থেকে দূরে থাকল না। কিন্তু এ প্রশ্ন কে করবেÑ পুলিশ কেন কাছে এলো এবং তাকে তুলে নিয়ে গেল? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্যে এই বর্বরতা অনুমোদিত হয়েছে। এটা গণতান্ত্রিক সমাজে তো নয়ই, কোনো সামন্ততান্ত্রিক সমাজেও সম্ভব ছিল না। টুকু একজন মন্ত্রী হয়ে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বললেন। এবং প্রধানমন্ত্রী তাকে সতর্ক পর্যন্ত করলেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তার বক্তব্যের জন্য বহু আগেই মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কার করা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা-ও করেননি। ফলে মনে হয়, এর সব কিছুই প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করছেন। অর্থাৎ একজন লোককে যে পুলিশ ধরে আনবে, সে পুলিশ কি না তা চিহ্নিত করার কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। যে কেউ যে কাউকে যখন-তখন গুম বা খুন করতে পারবে এবং মুক্তিপণ আদায় করতে পারবে। 
এ কেমন স্বদেশ আমার! এ কেমন সরকার! এ কেমন রাষ্ট্র পরিচালনা! একজন নাগরিক হিসেবে আমি এখন কার কাছে যাবো? আমি অনেক আগে থেকেই কাছে থানার ফোন নম্বর রাখি। যদি কোনো বিপদে পড়ি, তাহলে যেন পুলিশের সাহায্য চাইতে পারি। সেটাই শৈশব থেকে এ ঊনষাট বছর বয়স পর্যন্ত শিখে এসেছি। এখন মনে হচ্ছে, এর সব কিছু অর্থহীন।
গত ৩১ মে আমার স্ত্রী মরিশাস থেকে দিল্লি-কলকাতা হয়ে ঢাকা ফিরছিলেন। আমি এয়ারপোর্টের বাইরে হাজী ক্যাম্প রোডে গাড়ি পার্ক করেছিলাম চা খাওয়ার জন্য। কলকাতা থেকে তিনি বাংলাদেশ বিমানে আসছিলেন। যে বিমান ল্যান্ড করার কথা রাত ৮টায়, সেটা ল্যান্ড করল রাত সোয়া ১১টায়। ড্রাইভার নতুন। সে পার্কিং সেরে আসতে পারবে কি না নিশ্চিত ছিলাম না। ফলে সেখানেই হাঁটাচলা করছিলাম। একজন লোককে দেখলাম, খোট্টা চায়ের দোকানে অবিরাম চা-সিগারেট খাচ্ছেন। আমি রেললাইনের দিকে চলে গেলাম। রেললাইনের এদিক-ওদিক হেঁটে আধাঘণ্টা পর ফিরে এলাম। ফিরে এসে দেখি ছোট করে চুলছাঁটা সেই লোকটা তখনো খোট্টা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার মনে হলো, লোকটা পুলিশ-ডিবি কিংবা র‌্যাব কি না যাদের পরিচয়ের কোনো দরকার নেই। আমার ভয় হতে লাগল। এই লোকটা বুঝি এখনই আমাকে বলবে, আমি পুলিশ বা র‌্যাবের লোক, আপনি আমার সাথে চলুন। 
সৌভাগ্যবশত সে তেমনটা বলেনি। অর্থাৎ অবিবাহিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অবিবেচক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের কারণে একজন নাগরিকের যে আতঙ্ক হয়, সেটা আমি ওই দিন রাতে সরাসরি উপলব্ধি করলাম। সারা দেশেই সাধারণ মানুষ এটা উপলব্ধি করছে, পুলিশ বা র‌্যাব নীতিনৈতিকতাবিহীন পৈশাচিক-ইতর আচরণ করেই যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী সেগুলো অনুমোদন তো করছেনই, উপরন্তু সাংবাদিক তথা নাগরিক সমাজকে জানান দিতে চাইছেন যে, তারা যদি বাঁচতে চান তাহলে যেন পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকে। 
যদি আমার বাসায় ডাকাত পড়ে তাহলে আমি কার কাছে যাবো? স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পরামর্শ দিয়েছেন পুলিশ থেকে নিরাপদ দুরত্বে থাকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পুলিশ আগের চেয়ে অনেক ভালো। আর পুলিশের এসপি-এসআই ক্রমাগত অর্থ ও নারী কেলেঙ্কারির সাথে জড়িয়ে পড়ছেন। জবাবদিহিতার কোনো প্রশ্নই আসে না। যে পুলিশ অত্যাচার-নির্যাতন-নারী কেলেঙ্কারি করে, তাকে কোজ করা হয়। অথবা ভিন্ন কোথাও বদলি করা হয়। তা কি শাস্তি? এই সরকার জবাবদিহিতাহীন হওয়ার জন্য পুলিশকেও জবাবদিহিতাহীন করে দিয়েছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
সারা পৃথিবী বলছে, সরকার অন্যায় করছে। সরকার বিরোধী দলকে দমনের জন্য মতার অপব্যবহার করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণহীন করে তুলেছে।
সরকার অবশ্য নির্বিকার। জন্মান্ধ সরকার কোনো কিছুকেই বিবেচনায় নিতে চাচ্ছে না। না চাক। কিন্তু নাগরিকদের কী হবে? তারা যাবে কোথায়? কার কাছে নিরাপত্তা চাইবে? কার কাছে হেফাজত চাইবে? সাধারণ জবাব হলোÑ সরকারের কাছে। কিন্তু সরকার বলে দিয়েছে, পুলিশ থেকে দূরে থাকুন। আর সে কারণেই পুলিশ এখন আতঙ্কজনক হিংস্র হায়েনায় পরিণত হয়েছে। এখন পুলিশ দেখলেও নাগরিকেরা ভীত-সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েন। 
এসব নির্বোধ-অপদার্থ-অশিতি-কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্ত্রী নিয়ে শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনা করবেন, যদি এ রকম ভেবে থাকেন, তাহলে ভারি ভুল হয়ে গেছে। এর পরিণতিও সুখকর হওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও জানেন, তিনি কিভাবে মতায় এসেছেন, তাকে কারা মতায় বসিয়েছে। ভারত সেখানে একমাত্র ফ্যাক্টর নয়। এবং আশা করি ভারতের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক তৎপরতা থেকে প্রধানমন্ত্রী উপলব্ধি করেছেন যে, তারাও তার সরকারের এমন নষ্ট ও ইতর আচরণ এখন আর সহজভাবে নিচ্ছে না। 
অর্থাৎ জনগণ একটা বিরাট ফ্যাক্টর। শেখ হাসিনার সরকার জনগণ-ফনগণ এ রকম বিষয় নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাচ্ছে বলে মনে হয় না। তিনি যা বলবেন, জনগণ সেটাই করবে। এটাই জনগণের দায়িত্ব। তিনি সরকার বাহাদুর। ফলে তার কথার বাইরে এই পৃথিবীতে আর কিছুই ঘটানোর অবকাশ নেই। 
শেখ হাসিনার সরকার আসলে কোনো সরকারই নয়। এখন মনে হচ্ছে, এরা যেন ভারতের সেবাদাস মাত্র। সারা পৃথিবীতে কী ঘটছে না ঘটছে, সে পরিপ্রেেিত আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কী হওয়া উচিত না উচিত, এসব বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞানও এ সরকারের নেই। অটোগ্রাফ-বিলাসী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুদর্শনা দীপু মনি সারা পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছেন। সম্ভবত সাড়ে তিন বছরে তার শততম সফর সম্পন্ন হয়েছে। ফলাফল শূন্য। সৌদি আরব তার কূটনীতিক হত্যার যথাযথ তদন্ত না হওয়ায় এখন বৈধ বাংলাদেশীদেরও বের করে দিচ্ছে। গোটা মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের কর্মসংস্থান প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুচ্ছ তুচ্ছ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার নামে ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ করছেন। ফলাফল শূন্য। 
এই সরকারের চরম দুর্নীতির কারণে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ, সিডা সব সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতিবাজদের কোলে তুলে আদর করছেন। এখন মনে হচ্ছেÑ তিনি বলেছিলেন যে দেশের মানুষ শেখ মুজিবের হত্যার বিচার করেনি, তাদের কষ্ট হওয়াই উচিত; সেটা তিনি বদ্ধপরিকরভাবে বাস্তবায়ন করছেন। ফলে এখন একচল্লিশ বছরের মধ্যে নিকৃষ্ট জনঘাতক শাসন বাংলাদেশে চালু হয়েছে। 
আমরা ধারণা করেছিলাম, ২০০১ সালের নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগ শিা নেবে বা নিয়েছে। আমাদের ধারণা ভুল। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে, যেটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন খুব স্পষ্ট ভাষায় শেখ হাসিনাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে কিভাবে তাকে মতায় আনা হয়েছে। কিন্তু মতায় এসে তার সরকার বলছে, পুলিশ হইতে সাবধান। অর্থাৎ এই সরকার জনগণকে হালাক করবে। জনগণকে তা মেনে নিতে হবে। তাই কি জনগণ কখনো মেনে নেয়? আমরা সেই প্রতিরোধের অপোয় আছি। সেটা খুব বেশি দূরে নয়। 
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন