মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১২

বন্ধু গো, বড় বিষজ্বালা এই বুকে...



ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : 
কোনো শাসক গোষ্ঠীর কাছেই সাংবাদিকরা কখনও ভালো হতে পারলো না। শাসকরা কেবলই সাংবাদিকদের সব সময় শাসায়। হুমকি-ধামকি দেয়। তারপর পুলিশ দিয়ে পিটায়। পুলিশকে তেমন নির্দেশ দিতে দিতে এখন পুলিশকে আর নির্দেশ দিতে হয় না। পুলিশ নিজেই এখন সে দায়িত্ব আপন জিম্মায় নিয়ে নিয়েছে। সেই পাকিস্তান আমল থেকেই দেখছি, পুলিশ আর সাংবাদিক রাজপথে পাশাপাশি অবস্থান করে যার যার দায়িত্ব পালন করে গেছে। সে সময় পুলিশ কোনো সাংবাদিকের গায়ে হাত তুলেছে বলে শুনিনি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে পরিস্থিতি দ্রুতই বদলে যেতে থাকে। আমি সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দিয়েছি ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তারপর এই চল্লিশ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কেবল নিগ্রহই দেখে আসছি। আগে ইলেকট্রনিক মিডিয়া বলতে সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ বেতার আর বাংলাদেশ টেলিভিশন ছিল। সুতরাং সাংবাদিকতা বলতে প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদেরই বোঝাতো। এখন বেসরকারি খাতে রেডিও ও টেলিভিশন এসেছে। মুক্ত সাংবাদিকতা শুরু হয়েছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরাও সে কাতারে যুক্ত হয়েছেন। দলেবলে, কলেবরে সাংবাদিক অনেক বেড়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সাংবাদিক নিগ্রহের মাত্রা। ১৯৭২-৭৫ সালে সেই অর্থে বিরোধী মনোভাবাপন্ন সংবাদপত্র ছিল মাত্র দুটি। দৈনিক গণকণ্ঠ। আর মওলানা ভাসানী প্রকাশিত সাপ্তাহিক হককথা। এনায়েত উল্লাহ খান সম্পাদিত ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডে। এছাড়া অল্প সময়ের জন্য প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক স্পোকস্ম্যান ও মুখপত্র দুটি পত্রিকা। আর ছিল চট্টগ্রামের ইস্টার্ন এক্সামিনার। এর কোনোটাই সরকারী রোষমুক্ত ছিল না। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার আন্দোলনকারী শেখ মুজিবুর রহমান এই সকল সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে উঠেছিলেন।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের জন্য নানা কালো আইন জারি করেছিলেন। নিউজপ্রিন্ট নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ, প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স, বিশেষ ক্ষমতা আইন-এর সবকিছুই সে সময়  জারি করা হয়েছিল সংবাদপত্রগুলো দলনের জন্য। তখনও সাংবাদিকরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান সরকার পুলিশ বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছেন। স্পোকসম্যান-মুখপত্র সম্পাদককে গ্রেফতার করে তার অফিসে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রায় প্রতিদিন গণকণ্ঠ অফিসে পুলিশ হামলা চালিয়েছে। প্রেস ম্যাটার-গ্যালি ভেঙে দেয়া হয়েছে। এর সম্পাদক আল মাহমুদকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। হলিডে সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। হককথার সম্পাদককে গ্রেফতার করে পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণের জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। এমনকি চিন্তার স্বাধীনতাও কেড়ে নেয়া হয়েছিল। এতেও সম্ভবত শেখ মুজিবুর রহমান সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। ফলে ১৯৭৫ সালে দেশের সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করে এবং কেবলমাত্র তার গুণগান গাইবার জন্য চারটি পত্রিকা সরকারি নিয়ন্ত্রণে রেখে বাকি সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছিল। নিজ দল আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে গঠন করেছিলেন বাকশাল।
এরপর এই দীর্ঘসময়ে সংবাদপত্র বা মিডিয়া কখনও নিরবচ্ছিন্ন স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেনি। সকল সরকারের আমলে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা কোনো না কোনোভাবে নাজেহাল হয়েই গেছেন। ১৯৭২-৭৫ সালে যেমন সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে তৎকালীন পাতিনেতারা একেবারে উচ্চকণ্ঠে সমালোচনা শুরু করেন। শেখ মুজিব যদি এক বাক্য বলতেন তাহলে উনারা বলতেন চার পৃষ্ঠা। এই তো হয়। এখনও তেমনই দেখছি। শেখ হাসিনা যদি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দু'কথা উচ্চারণ করেন, অমনি তার সাঙ্গপাঙ্গ ও দৃষ্টি আকর্ষণে উদগ্রীব নেতারা শতমুখে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকেন। ১৯৯৬-২০০১ সালেও এমনই দেখেছি। এসময়ও শেখ হাসিনা সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে তার স্বভাবসুলভ শ্লেষাত্মক মন্তব্য করতে ছাড়েননি।
সংবাদপত্রগুলো লিখে কোনো সরকারের পতন ঘটাতে চায় বা পারে বলে মনে করি না। সাংবাদিকরা লেখেন সরকারকে সংশোধিত হওয়ার জন্য। সরকারের ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু এই ভুল ধরিয়ে দিতে গিয়ে তারা পদে পদে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী হামেশাই সাংবাদিকদের কষে গাল দিতে কসুর করছেন না। ফলে ৭২-৭৫এর মতোই তার সাঙ্গপাঙ্গরা বহুমাত্রায় উৎসাহিত হয়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অবিরাম নানা বিষোদগার করে যাচ্ছে। আর মন্ত্রী-এমপিরা যখন শতমুখে সাংবাদিকদের কঠোর সমালোচনা করছেন, তখন তাদের অনুগত পুলিশ বাহিনী সোৎসাহে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে বেধড়ক পিটুনি দিচ্ছে। আগে তো তবু  সরকারের মন্ত্রীরা এসব কাজের জন্য পুলিশকে ধমক-টমক দিতেন। এখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী গত ২৯ মে সাংবাদিকদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা যেন পুলিশ থেকে সাবধান থাকে। হায় রাষ্ট্র! হায় সরকার! হায় হায় পুলিশ বাহিনী! আগে এসব অপকর্মের জন্য পুলিশের বিরুদ্ধে লোক দেখানো হলেও, কিছু একটা ব্যবস্থা নেয়া হতো। এখন দেখা যাচ্ছে, এসব কাজের জন্য সরকার পুলিশকে তিরস্কারের বদলে পুরস্কৃত করছে। ফলে তাদের মধ্যে সাংবাদিক পেটানোর উৎসাহ বহুগুণে বেড়ে গেছে। এর পরদিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেছেন, পুলিশ আগের চেয়ে অনেক ভাল হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও গত ২ জুন দলীয় এক সভায় বলেছেন যে, ‘মিডিয়া সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই সরকারের বিরুদ্ধে লিখছে। প্রতিদিন সরকারের বিরুদ্ধে না লিখলে তাদের পেটের ভাতই হজম হয় না। সরকারের বিরুদ্ধে তাদের লিখতেই হবে। কিন্তু আমরা কখনও তাদের বাধা দেই না।' তিনি দাবি করেছেন যে, তার সরকারের আমলে মিডিয়া সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে লিখছে। কিন্তু এই স্বাধীনতার অপব্যবহারও হচ্ছে। প্রতিদিন মিডিয়া ভুয়া খবর দেয়। তাতে দেশের যে কি ক্ষতি হয়, তারা তা বুঝতেও পারে না। তার সরকার ভালোভাবেই দেশ পরিচালনা করছে। কিন্তু এটাই অনেকের সহ্য হচ্ছে না। যে কারণে তাদের সমালোচনার শেষ নেই। শেখ হাসিনা নিজে টিভির টকশোগুলোর কঠোর সমালোচক। তিনি বলেছেন, টিভির টকশো দেখলে দেশের এক চিত্র পাওয়া যায়। আর গ্রামে দেখা যায় অন্য চিত্র। অনেকেই আছেন দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকলে তাদের ভাল লাগে না। তারা সব সরকারের কাছ থেকেই সুবিধা নিতে অভ্যস্ত। তারাই বলে বেড়ান, দেশটা নাকি ভাল চলছে না। সবক্ষেত্রেই সরকারের অনেক সাফল্য থাকলেও যারা ভালটা দেখেন না, তারা আসলে চানই না দেশটা ভাল থাকুক। জনগণ স্বস্তিতে থাকুক।
প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সুনামগঞ্জের সুনামখেকো ঘুষের টাকার বস্তাওয়ালা দফতর হারানো মন্ত্রী নিলাজ কানাই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলে বসেছেন যে, গণমাধ্যমকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তার এপিএস-এর টাকার বস্তা ধরা পড়ার পর গণমাধ্যম কেন অতি দ্রুততার সঙ্গে সেটি প্রচার করল, তা নিয়ে সুরঞ্জিতের ক্ষোভের অন্ত নেই। অতই যদি সব ভাল তবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে রেল থেকে কেন সরালেন প্রধানমন্ত্রী? আবুল হোসেনকেই কেন বা যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরাতে হলো?
গণমাধ্যম খারাপ। কারণ গণমাধ্যম এসব ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেয়। সাংবাদিকের দায়িত্ব সেটাই। ভয়াবহ দুর্নীতির খবর হাতে পাওয়ায় জীবন দিতে হয়েছে সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনীকে। প্রতিদিন সারাদেশে কমপক্ষে দশ থেকে বারোটি খুন হচ্ছে। এখানে সেখানে শিশু, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার লাশ পাওয়া যাচ্ছে। যে যাকে যেখানে খুশি নির্বিবাদে খুন করছে। র‌্যাব-পুলিশ পরিচয়ে যখন তখন মানুষকে ঘরবাড়ি, রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কখনও তাদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে। কখনও পাওয়া যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর এমন অসহিষ্ণুতার খবর যেদিন প্রকাশিত হয়েছে, সেদিনও তার পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছে, এক তরুণীর ছাবিবশ টুকরা লাশের খবর। পুলিশকে মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্রয় দেয়ার ফলে তারা সাংবাদিক পেটাচ্ছে। আইনজীবী পেটাচ্ছে। তাদের চোখের সামনে থেকে গুম হয়ে গেছে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী। আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশ এক তরুণীর শ্লীলতাহানি ঘটিয়েছে। পুলিশের এসি-ওসিরা নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ছে। হাতেনাতে ধরা পড়ে গণপিটুনি খাচ্ছে। ডাকাতি করতে গিয়ে ছয় পুলিশ জনতার হাতে ধরা পড়ে উত্তম মধ্যম খেয়েছে। রাজপথে পুলিশ সাংবাদিক ও জনতার হলকম টিপে ধরছে। পথচারীর গলায় কিংবা বুকে পা দিয়ে চেপে ধরছে। বিরোধীদলের চীফ হুইপকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করছে। সাংবাদিকরা এর সমালোচনা করলে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন।
দেশে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি-জ্বালানির দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। দ্রব্যমূল্য আকাশ-ছোঁয়া। দেশ সম্পর্কে বিদেশের সঙ্গে কি চুক্তি হলো, তা জনগণকে জানানোর বিধান রহিত করা হয়েছে। ভারতকে একতরফা ট্রানজিট-করিডোর দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বন্দরগুলো ভারতের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে। ভারতীয় বিনিয়োগের স্বার্থে দেশীয় শিল্প-বাণিজ্য-ব্যবসা ধ্বংস করা হচ্ছে। বিদেশে বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। ঢাকা কঠোর নিরাপত্তা জোন গুলশানের কূটনীতিক পাড়ায় সৌদি কূটনীতিক খুন হয়েছেন। তার কোনো ক্লুই খুঁজে পায়নি পুলিশ। স্বাভাবিকভাবেই বিরূপ হয়েছে সৌদি আরব, গোটা মধ্যপ্রাচ্য। ঘুষ-দুর্নীতিতে সকল সেক্টর যে সয়লাব, এটা অর্থমন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন। বড় দানের দুর্নীতির জন্য বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান তাদের সকল ঋণ স্থগিত করেছে। তিস্তার পানি পাওয়া যাচ্ছে না। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারত দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। অগ্রসর হচ্ছে নদীসংযোগ প্রকল্প নিয়েও। সরকার নিরব। ঢাকঢোল পিটিয়ে ভারত তাদেরই করিডোর সুবিধার জন্য শতকোটি ডলার ঋণদানের কথা ঘোষণা করেছিল। সেগুলোর অগ্রসর হয়নি। সুতরাং গণমাধ্যমে সাংবাদিকরা সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত হতে, গণতন্ত্রকে রক্ষা করতেই সরকারের সমালোচনা করে। সমালোচনা না করলে তাদের পেটের ভাত হজম হয় না, এমন কথা তাই সম্ভবত বলা যায় না।
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘আমার কৈফিয়ৎ' কবিতায় লিখেছেন, ‘‘বন্ধু গো আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!/ দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।/ রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,/ তাই লিখে যাই রক্ত-লেখা,/ বড় কথা, বড় ভাব আসেনা'ক মাথায়, বন্ধু বড় দুঃখে!/ অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছো সুখে!/ ... প্রার্থনা ক'রো-যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস।/ যেনো লেখা হয় আমার এ রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!’’
সাংবাদিকদের অবস্থাও বোধকরি এখন তেমনই দাঁড়িয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন